Skip to main content

আমার সৃষ্টিকর্তা—আল্লাহ


In the name of Allah, the Most Gracious, the Most Merciful
আল্লাহর নামে, যিনি পরম করুণাময়, পরম দয়ালু


ভূমিকা

“তিনি সবকিছুকে সুন্দরভাবে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা সিজদা ৩২:৭)

আমি যখন ৬১ বছরে পা রেখেছি, তখন শুধু অতীত স্মৃতিই নয়, বরং নিজের সত্ত্বার প্রতিটি পরতে পরতে আল্লাহর সৃষ্টি-সৌন্দর্য অনুভব করি। আমি এক অলৌকিক সৃষ্টি—আল্লাহর হাতে গড়া। গর্ভের একটি বিন্দু থেকে আজকের আমি—প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি হৃদস্পন্দন, আমার দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই এক একটি নিদর্শন।

এই বই শুধুই আমার জীবনের গল্প নয়, এটি এক মহাসত্যের স্বীকৃতি—আমি আল্লাহর এক অপূর্ব সৃষ্টি।


১ম অধ্যায়: জীবনের উপহার

“স্মরণ করো, যখন তোমার প্রতিপালক ফিরিশতাদের বললেন, ‘আমি মানুষ সৃষ্টি করবো কাদামাটি থেকে।’” – (সূরা সাদ, ৩৮:৭১)

আমি আজ ৬১ বছর বয়সে পা দিলাম—জীবনের এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে আমি দেখেছি সুখ-দুঃখ, আলো-আঁধারির বহু চিত্র। জন্মদিনে আমার প্রিয়জনেরা—আমার ছেলে, পুত্রবধূ, স্ত্রী এবং কাছের মানুষরা ভালোবাসা ও শুভকামনায় আমাকে ঘিরে রেখেছে, ঠিক আগের বছরের মতোই। হাসিমুখে কেক কাটা, কিছু পুরনো ছবি, ভালোবাসায় ভরা কিছু শব্দ—সব মিলিয়ে দিনটি খুব সুন্দর কেটেছে।

কিন্তু আজকের এই দিনে, সবার ভালোবাসার মাঝেও মনে হলো, আমি একটু ভাবি — আমি কে? এই আমি, যার চোখ আছে, কান আছে, হাত আছে, মন আছে — আমি কীভাবে তৈরি হলাম? কে আমাকে এমন নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করলেন ? কীভাবে আমি ছোট্ট এক বিন্দু থেকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠলাম ?

এই দেহটা, এই মনটা, এই চিন্তাগুলো—আমি নিজে কি বানিয়েছি ? না, বরং আমি তৈরি হয়েছি এক অলৌকিক পদ্ধতিতে, এক অদৃশ্য পরিকল্পনায়, যার কারিগর হচ্ছেন আমার সৃষ্টিকর্তা—আল্লাহ।

আজ, এই বিশেষ দিনে আমি শুধু জন্মদিন নয়, নিজের সৃষ্টি দিবস নিয়েও ভাবছি । কীভাবে তিনি আমাকে এক ফোঁটা পানির বিন্দু থেকে রক্তের দলায় রূপ দিলেন, তারপর হাড়, মাংস, চর্ম, চেতনা ও চেতনাবিহীন দেহে রূহ ফুঁকে দিলেন!

আমার শ্বাস নেওয়া, দৃষ্টি, শ্রবণ, অনুভূতি—সবই এমন কিছু, যা আমি নিজে তৈরি করিনি, চাইলেও তৈরি করতে পারতাম না। আমার জন্মও ছিল না আমার নিজের হাতে। একটি ক্ষুদ্র বিন্দু থেকে আমার অস্তিত্বের শুরু—মায়ের গর্ভে একটি অদৃশ্য প্রক্রিয়ায় আমি বৃদ্ধি পেতে থাকি। কুরআনে আল্লাহ বলেন:

“আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটি থেকে, তারপর তাকে রাখি নিরাপদ আশ্রয়ে (গর্ভে)।” – (সূরা আল-মুমিনুন, ২৩:১২-১৩)

সেই গর্ভের অন্ধকার থেকে বের হয়ে আমি আলোর মুখ দেখি, কান দিয়ে শব্দ শুনি, চামড়ার স্পর্শে শীত-গরম বুঝি। কে আমাকে এসব দিয়েছেন? আমি তো নিজেই জানি না কীভাবে আমার চোখ গঠিত হয়েছে, কীভাবে আমার হৃদয় প্রতিনিয়ত ধুকপুক করছে। তাহলে একে কাকতালীয় বলা যায় কি?

আমার দুই হাত, পাঁচ আঙুল, দুটি চোখ, হৃদয়, ফুসফুস—সবই অসাধারণভাবে কাজ করছে। যেগুলোর প্রতিটির গঠন ও কার্যপদ্ধতি এত জটিল ও নিখুঁত, যা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীও পুরোপুরি অনুকরণ করতে পারেন না।

“তিনি তোমাদেরকে গঠন করেছেন এবং সুন্দর করেছেন তোমাদের আকৃতি।” – (সূরা আল-ইনফিতার, ৮২:৭-৮)

তাহলে আজ এই বইয়ের শুরুতেই নিজের জন্য, নিজের মতো প্রতিটি পাঠকের জন্য বলি— আমরা প্রত্যেকেই এক একটি অলৌকিক সৃষ্টি, এক একটি আল্লাহর নিদর্শন।

আমি জানি না, আগামীতে আমি কতদিন বাঁচব, কিন্তু আজ আমি জানি, আমি কেবলই একটি জীব নয়, আমি একটি উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টি। আমার দেহ, আমার চিন্তা, আমার স্মৃতি—সবই এক মহান পরিকল্পনার অংশ।

এই অধ্যায়ে আমি নিজের জীবন, দেহ এবং অস্তিত্বকে নতুন দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করছি—শুধু একজন মানুষের জীবনপথ হিসেবে নয়, বরং একে আল্লাহর দেওয়া এক অপূর্ব উপহার হিসেবে গ্রহণ করছি।


অধ্যায় ২: অদৃশ্য অন্ধকার থেকে আলোর পথে

আমার সৃষ্টি শুরু হয়েছিল এমন এক জায়গা থেকে, যেটা আমি দেখিনি, জানিনি—তবুও যার গভীর নিরবতা ও নিখুঁত পরিকল্পনার মাঝে গড়ে উঠেছিল আমার অস্তিত্ব। মা'র গর্ভ—একটি নিরাপদ অন্ধকার ঘর, যেখানে আমি ছিলাম এক বিন্দু পানির মতো, নির্ভরশীল, নিঃসহায়, অথচ আল্লাহর পরম কুদরতে গঠিত হচ্ছিলাম ধাপে ধাপে।

কোরআনে আল্লাহ বলেন: “অতঃপর আমি ওই শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তে পরিণত করি, তারপর সেই জমাট রক্তকে গোশতের দলায় রূপ দিই…” (সূরা আল-মুমিনূন: ১৪)

কি চমৎকার ছিল সেই সৃষ্টি-পর্যায়! ছোট্ট এক কোষ, তারপর একটু একটু করে হাড়, মাংস, ত্বক, চুল, চোখ—সব কিছুই গড়ে উঠলো একটি অলৌকিক ছকে। কিচ্ছু ছিল না আমার হাতে—তবুও সবকিছু হয়ে গেল যথাসময়ে, যথাযথভাবে।

আমি যখন দুনিয়ায় এলাম, তখন আমি কিছুই জানতাম না। না ভাষা, না চিন্তা, না অনুভূতি—কিন্তু আমার ভেতরে ছিল আল্লাহর দেওয়া এমন এক শক্তি, যা আমাকে শেখাবে হাঁটা, বলা, ভালোবাসা, কাঁদা, হাসা।

আজ ৬১ বছর পেরিয়ে ফিরে তাকালে মনে হয়—আমি কত অসহায় ছিলাম, আর কত দয়ার সাথে আল্লাহ আমাকে গড়ে তুলেছেন! তখন থেকেই আমি ছিলাম আল্লাহর কুদরতের এক চলমান চিহ্ন।

আমার জন্ম ছিল নিছক কোনও জৈবিক প্রক্রিয়া নয়, বরং একটি নিরব অলৌকিকতা, যা আমি এখন বুঝি—এই বয়সে এসে।


অধ্যায় ৩: চোখের আলো, কানের সুর—আমি কীভাবে অনুভব করতে শিখলাম?

আল্লাহ আমাকে শুধু একটি দেহ দেননি, দিয়েছেন অনুভব করার আশ্চর্য শক্তি। চোখ, কান, ত্বক, মন—সব কিছুই যেন একটি করে জানালা, যার মাধ্যমে আমি পৃথিবীকে দেখতে ও বুঝতে শিখেছি।

আমি প্রথম আলো দেখি—তীব্র, নতুন, অজানা। কিন্তু সেই আলোই তো আমাকে দেখার পথ দেখিয়েছে।

চোখ, দুটি ছোট্ট বলের মতো, কিন্তু আল্লাহ তাতে এমন এক জটিল কৌশল বসিয়েছেন—যা আমার সামনে পৃথিবীকে রঙে, আকারে, আলোছায়ায় জীবন্ত করে তোলে।

একটি শিশুর চোখ ধীরে ধীরে আলোর সঙ্গে পরিচিত হয়। প্রথমে কিছুই বোঝে না, কিন্তু ধীরে ধীরে চিনে ফেলে মায়ের মুখ, আলাদা করে রঙ চিনে, অনুভব করে কোনটা নরম আর কোনটা শক্ত। এই প্রতিটি ধাপে আল্লাহর অপার রহমত প্রকাশিত হয়—যে তিনি অদৃশ্য থেকে ধীরে ধীরে আমাদের সামনে জগৎকে উন্মুক্ত করেন।

কান, প্রথমে শব্দকে শুধু শোনে। এরপর তা পরিচিত হয় শব্দের অর্থে—মায়ের কণ্ঠ, আদরের সুর, হাসির শব্দ, আযানের ধ্বনি। একসময় এই কানই আমাকে বানিয়েছে শ্রোতা, পরে ভাষা বোঝার পথ খুলে দিয়েছে। আমি কথা শিখেছি, মানুষ বুঝেছি, আল্লাহর কালাম শুনেছি—এই কানের মাধ্যমে।

আল্লাহ বলেন: “আল্লাহ তোমাদের মাতৃগর্ভ থেকে বের করেছেন—তখন তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন শ্রবণ, দৃষ্টি ও হৃদয়—যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও।” (সূরা নাহল: ৭৮)

এই চোখ আর কান ছাড়াও ছিল অনুভব করার শক্তি— হৃদয়, যা কেবল রক্ত পাম্প করে না, বরং ভালো-মন্দ বুঝে, ভয় পায়, ভালোবাসে, আল্লাহকে অনুভব করে। আমি ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছি—কে আপন, কে পর, কোনটা সত্য, কোনটা ভুল। এই জ্ঞান এসেছে সেই অদৃশ্য শক্তি থেকে, যেটি আল্লাহ আমার ভিতর স্থাপন করেছেন।

আজ ৬১ বছরে এসে আমার চোখ হয়তো কিছুটা ঝাপসা, কানে কম শুনি, মনও ক্লান্ত হয়, কিন্তু আমার কৃতজ্ঞতা দিন দিন বাড়ছে—এই উপলব্ধি আমাকে নতুন আলোয় ভরিয়ে দিচ্ছে। আমি সত্যিই আশ্চর্য হই—আমি কীভাবে এত কিছু পেয়েছি, এত কিছু শিখেছি? এর একমাত্র উত্তর: আমার প্রভু, আমার স্রষ্টা—আল্লাহ।


অধ্যায় ৪: আমার হাত, আমার পা — চলার পথ, কাজের শক্তি

শিশু অবস্থায় আমি একসময় হাঁটতে শিখেছি, হাতে ধরেছি জিনিস, টানতে, ধরতে, ফেলে দিতে শিখেছি। তখন এসব ছিল কেবল খেলা, কিন্তু এখন বুঝি—এই ছোট ছোট কাজগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে ছিল এক অসাধারণ প্রশিক্ষণ। আল্লাহ আমাকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন, যেন আমি ধাপে ধাপে জীবন গড়ার শক্তি পাই।

আমার হাত—এই হাত দিয়েই আমি খেতে শিখেছি, লিখেছি, আঁকতে শিখেছি, কাজ করতে শিখেছি। এই হাত দিয়েই আমি মায়ের হাত ধরেছি, সন্তানের মাথায় হাত বুলিয়েছি, বন্ধুর কাঁধে হাত রেখেছি। এখন ৬১ বছর বয়সে এসেও যখন হাত কাঁপে, আমি তবুও কৃতজ্ঞ—কারণ এই হাতে অনেক স্মৃতি জমা আছে।

আমার পা—প্রথমে কেবল হামাগুড়ি, তারপর ডগডগে হাঁটা, তারপর দৌড়। এই পায়েই আমি মসজিদে গিয়েছি, স্কুলে ছুটেছি, জীবিকার খোঁজে হেঁটেছি মাইলের পর মাইল। এখন হয়তো ক্লান্ত হয় পা, ব্যথাও পায় মাঝে মাঝে, কিন্তু আমি জানি—এই পা আমাকে অনেক দূর নিয়ে গেছে।

আল্লাহ বলেন: “আমি কি তাকে দুটি চোখ দেইনি? এবং একটি জিহ্বা ও দুটি ঠোঁট? এবং আমি কি তাকে দুটি পথ (সৎ ও অসৎ) দেখাইনি?” (সূরা বালাদ: ৮-১০)

এই অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো কেবল দৈহিক কাঠামো নয়, বরং এগুলো আমার জীবনের বাহন, আমার কাজের মাধ্যম, আমার ইবাদতের অংশ। এখন আমি উপলব্ধি করি—এই দেহ আমি নিজে বানাইনি, এ এক মহান কারিগরের সৃষ্টি। তিনি জানেন কীভাবে আমাকে গঠন করলে আমি চলতে পারব, গড়তে পারব, তাঁর দিকে ফিরে যেতে পারব।


অধ্যায় ৫: কথা বলা, ভাষা শেখা—আমি কীভাবে ভাব প্রকাশ করতে শিখলাম?

প্রথম শব্দ— মা। এই একটি শব্দ দিয়েই আমার মুখ খুলেছিল। তারপর আসতে থাকে আরও শব্দ, ভাঙা ভাঙা বাক্য, ধীরে ধীরে পুরো ভাষা। কথা বলা ছিল আমার জীবনের আরেকটি অলৌকিক অধ্যায়। আমি নিজে কিছুই জানতাম না, কিন্তু আল্লাহ এমনভাবে আমার জিহ্বা, ঠোঁট, মস্তিষ্ক এবং শ্রবণক্ষমতা গড়েছেন যে আমি এক সময় বুঝতে শিখলাম—কে কী বলছে, আর আমি কীভাবে উত্তর দিতে পারি।

ভাষা শুধু কথা বলার মাধ্যম নয়, এটি ভাব প্রকাশের, ভালোবাসা জানাবার, কষ্ট বলার, দোয়া করার, কুরআন তেলাওয়াতের এক মহান উপহার। আমার জিহ্বা, কণ্ঠনালী ও মন—এই সবকিছু মিলেই তো আমার কথার জন্ম দেয়। এটা এমন এক নিয়ামত, যা না থাকলে আমি কখনোই বুঝাতে পারতাম না—আমি কী চাই, কী অনুভব করি, কী জানতে চাই।

আল্লাহ বলেন: “(আল্লাহ) দয়ালু। তিনি কুরআন শিখিয়েছেন, মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তাকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন।” (সূরা আর-রাহমান: ১–৪)

আমি ভাবি, এমন সুন্দরভাবে যখন আল্লাহ আমাকে ভাষা ও বাকশক্তি দিয়েছেন, তখন এই শক্তিকে আমি কীভাবে ব্যবহার করেছি? আমি কি শুধু দুনিয়ার কথা বলেই কাটিয়ে দিলাম, না কি আল্লাহর প্রশংসা করেছি, কুরআন পড়েছি, মানুষকে ভালো কথা বলেছি?


অধ্যায় ৬: হৃদয়, অনুভব আর বিবেক

আমার দেহের মাঝে এক অদৃশ্য শক্তি কাজ করে, যেটা শুধু রক্ত দিয়ে চলে না—চলে অনুভূতি দিয়ে, বিবেচনা দিয়ে, ভালোবাসা আর ঘৃণার মাঝের সূক্ষ্ম রেখা দিয়ে। সেটা আমার হৃদয়।

এই হৃদয় কেবল একটি অঙ্গ নয়, এটি আমার অনুভবের কেন্দ্র, আমার বিবেকের ঠিকানা। আমি কী ভালোবাসব, কাকে শ্রদ্ধা করব, কী দেখে আনন্দ পাবো, কোন কথা শুনে চোখে জল আসবে—এসবই হৃদয়ের গভীর থেকে জন্ম নেয়।

আল্লাহ আমার ভেতরে এই আলো দিয়েছেন। যেন আমি শুধু বাইরের জগৎ না দেখি, বরং ভেতরেও তাকাই—কী সঠিক, কী ভুল, কী ন্যায়, কী অন্যায়। সেই ছোটবেলা থেকে, আমি যখন প্রথম অপরকে কষ্ট দিতে দেখে কাঁদেছিলাম, কিংবা কারও জন্য মন খারাপ হয়েছিল—সেই প্রথম আলামত ছিল, আমার হৃদয় জেগে উঠছে।

আল্লাহ বলেন: “চোখ অন্ধ হয় না, বরং বুকের মধ্যে যে হৃদয় আছে, সেটাই অন্ধ হয়ে যায়।” সূরা হজ্জ: ৪৬)

আমার বয়স বাড়ছে, কিন্তু আমি আজও টের পাই—এই হৃদয়টাই আসল। এটা যদি আল্লাহর ভয় না পায়, এটা যদি অন্যের কষ্টে কেঁদে না ওঠে, তাহলে আমি বুঝি না, আমি কীভাবে মানুষ হয়ে বেঁচে আছি?

এই হৃদয় আল্লাহর দিকে ফিরে যাক, সেই তো সবচেয়ে বড় চাওয়া। কারণ একদিন এই হৃদয়ই সাক্ষ্য দেবে—আমি কী চেয়েছি, কী ভালোবেসেছি, আর কোন পথ বেছে নিয়েছি।


অধ্যায় ৭: হাত-পা, চলাফেরা ও কাজ —আমি কীভাবে জীবনের পথ চলেছি?

আমি যখন নিজের হাত দুটো তাকিয়ে দেখি, তখন বুঝি—এই হাত শুধু কোনো জৈব কাঠামো নয়। এগুলো আমার জীবনের সহযাত্রী, আমার কাজের মাধ্যম, আমার দায়িত্ব পালনের যন্ত্র। জন্মের পর যখন প্রথমবার মায়ের আঙুল ধরেছিলাম, তখন থেকেই শুরু হয়েছিল এই হাতের গল্প।

এই হাত দিয়েই আমি খেতে শিখেছি, লিখতে শিখেছি, কাউকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেছি, কাউকে সাহায্য করেছি। কিন্তু এই হাত দিয়েই কি আমি কখনো অন্যায় কিছু করিনি? চিন্তা করলেই ভয় লাগে—এই হাত একদিন সাক্ষ্য দেবে আমার সকল কাজের।

আমার পা দুটো আমাকে এত দূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে—প্রথম হাঁটা, প্রথম স্কুল, কর্মজীবনের হাজারো গন্তব্য, মসজিদে যাওয়া, অসুস্থ কারও পাশে যাওয়া। এই চলাফেরা কোনো অর্থহীন ভ্রমণ ছিল না—এ ছিল জীবন গঠনের পথ। আর আমি কি সেই পথ সবসময় সঠিকভাবে বেছে নিয়েছি?

আল্লাহ বলেন: সেদিন আমরা তাদের মুখে সীলমোহর বসাব, তাদের হাত আমাদের সঙ্গে কথা বলবে এবং তাদের পা সাক্ষ্য দেবে, তারা যা করত সে বিষয়ে।”(সূরা ইয়াসিন: ৬৫)

আমি জানি, এই হাত-পা আজ আমার অনুগত, কিন্তু কেয়ামতের দিনে এরা নিজেরাই সাক্ষী হয়ে দাঁড়াবে—আমি কী কাজ করেছি, কী পথ বেছে নিয়েছি।

আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি — হে আল্লাহ, আমার হাত দিয়ে যেন আমি ভালো কাজই করি, আমার পা যেন আমাকে সরল পথে চালায়, আমার শরীর যেন তোমারই ইবাদতে ব্যয় হয়।


অধ্যায় ৮: আমার চোখ ও কান—আমি কী দেখেছি, কী শুনেছি, কেমন করে বিচার করেছি?

আমার চোখ—আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে বিস্ময়কর উপহারগুলোর একটি। আমি দেখতে পাই রঙ, আকার, সৌন্দর্য, ভালোবাসা, কান্না—সবকিছু। এই চোখ দিয়েই আমি প্রথম মায়ের মুখ দেখেছি, পৃথিবী চিনেছি, আলোকিত জীবন অনুভব করেছি।

তেমনি আমার কান—প্রথমবার মায়ের কণ্ঠস্বর, আজান, কুরআনের তিলাওয়াত, শিক্ষকের পরামর্শ, প্রিয়জনের মিষ্টি কথা—সবই এই কানের মাধ্যমে আমার মনে প্রবেশ করেছে।

কিন্তু আজ ৬১ বছরে এসে প্রশ্ন করি নিজেকে— আমি কী দেখেছি? কী শুনেছি? এই চোখ দিয়ে কি আমি কেবল আল্লাহর নিদর্শন দেখেছি? না কি আমি এমন কিছু দেখেছি যা চোখকে নোংরা করেছে, হৃদয়কে অন্ধ করেছে ? এই কান দিয়ে কি আমি সত্য শুনেছি? না কি গীবত, অপবাদ, অনর্থক ও অশোভন কথা শুনে সময় নষ্ট করেছি ?

আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয়ই শ্রবণ, দৃষ্টি ও হৃদয়—সবকিছুই একদিন জবাবদিহির আওতায় আসবে।” (সূরা বনি ইসরাঈল: ৩৬)

এই আয়াত আমাকে থমকে দেয়। মনে করিয়ে দেয়—আমার প্রতিটি দৃষ্টিপাত, প্রতিটি শোনা বাক্য আল্লাহর কাছে রেকর্ড হয়ে গেছে। আর একদিন আমাকে হিসাব দিতে হবে—আমি কী দেখেছি, কী শুনেছি, এবং কীভাবে তার বিচার করেছি।

আমি আল্লাহর কাছে হাত তুলে বলি — হে আল্লাহ, আমাকে এমন চোখ দিন, যা সত্য দেখে; এমন কান দিন, যা হক কথা শোনে; এমন হৃদয় দিন, যা বিচারে ন্যায়ের পথ অবলম্বন করে।


অধ্যায় ৯: আমার মুখ, ভাষা ও কথা—আমি কী বলেছি, কীভাবে বলেছি, কেন বলেছি?

আমার মুখ—যা দিয়ে আমি আহার গ্রহণ করি, কথা বলি, ভালোবাসা ও অনুভূতি প্রকাশ করি। এই মুখ দিয়েই আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি, কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করেছি, প্রিয়জনকে মমতাভরে ডেকেছি, কাউকে সান্ত্বনা দিয়েছি। আবার এ মুখ দিয়েই আমি কখনো রাগের বশে তীব্র কথা বলেছি, কাউকে কষ্ট দিয়েছি, এমনকি কখনো কাউকে অপমানও করেছি।

আল্লাহ আমাকে একটি জিহ্বা দিয়েছেন, যেটি ছোট হলেও এর প্রভাব অনেক বড়। একটি সদ্বাক্য যেমন কারো জীবন বদলে দিতে পারে, তেমনি একটি কটু কথা কাউকে চিরতরে ভেঙে ফেলতেও পারে। আমি যখন ফিরে দেখি জীবনের পথে—তখন ভাবি, আমার মুখের প্রতিটি উচ্চারণ কি আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে ছিল?

আল্লাহ বলেন: “মানুষ কোনো কথা উচ্চারণ করে না, কিন্তু তার কাছে প্রস্তুত একজন পর্যবেক্ষক থাকে (তা লিখে রাখার জন্য)।” (সূরা ক্বাফ: ১৮)

এই আয়াতের কথা মনে হলেই আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। প্রতিটি কথা আমার আমলের খাতায় লেখা হচ্ছে! হালকা মনে হলেও কথার ওজন আছে, ভালো বা মন্দ হিসেবে জমা হচ্ছে।

আমার এই মুখ দিয়ে আমি কী বলেছি—

  • কাউকে দোয়া দিয়েছি, না বদদোয়া?
  • সত্য বলেছি, না মিথ্যা?
  • উৎসাহ দিয়েছি, না নিরুৎসাহ করেছি?
  • গীবত করেছি, না প্রশংসা?

আমি বুঝেছি—ভাষা এমন এক নিয়ামত, যার মাধ্যমে আমি জান্নাতের পথেও চলতে পারি, আবার জাহান্নামের দ্বারেও পৌঁছে যেতে পারি।

আমি প্রার্থনা করি — হে আল্লাহ, তুমি আমার মুখকে করো পবিত্র, আমার জিহ্বাকে করো সত্যভাষী, আমার কথাকে করো শান্তির বার্তা। যেন আমি সেই মানুষদের অন্তর্ভুক্ত হই—যারা "কলেমা তাইয়্যিবা"র মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা লাভ করে।


অধ্যায় ১০: আমার হৃদয় ও অনুভূতি—আমি কাকে ভালোবেসেছি, কেন ভালোবেসেছি?

আল্লাহ আমাকে একটি হৃদয় দিয়েছেন—এমন একটি অদৃশ্য কিন্তু অনুভবযোগ্য স্থান, যেখানে ভালোবাসা, দয়া, দুঃখ, আনন্দ, ভয় এবং আশা একসঙ্গে বাস করে। এই হৃদয় দিয়েই আমি জীবনে কত মানুষকে ভালোবেসেছি—কখনো শর্তহীনভাবে, কখনো আবেগে ভেসে, কখনো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।

আমি ভালোবেসেছি আমার মাকে—কারণ তিনিই আমার জীবনের প্রথম আশ্রয়। আমার বাবাকে—কারণ তিনি ছিলেন ছায়ার মতো ছড়িয়ে থাকা এক নির্ভরতার নাম। ভালোবেসেছি আমার স্ত্রীকে—কারণ তিনি জীবনের আনন্দ-বেদনার সঙ্গী। আমার সন্তানদের, যারা আমার হৃদয়ের অংশ, আমার ভবিষ্যতের স্বপ্ন।

কিন্তু আমি কি সবাইকে ভালোবেসেছি আল্লাহর জন্য? আমার এই ভালোবাসাগুলো কি কেবল পার্থিব ছিল, না কি এর মধ্যে ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টির আশা? আমি যখন কাউকে আপন করে কাছে টেনেছি, তখন কি ভেবেছি—এই সম্পর্ক কি আমাকে জান্নাতের পথে সহায়তা করবে?

আমার হৃদয় কখনো দুঃখে কেঁদেছে, কখনো আনন্দে নেচেছে। কেউ আমাকে আঘাত করেছে, কেউ আমাকে দোয়া দিয়েছে। তবু এই হৃদয়কে আমি আজ একটি প্রশ্ন করতে চাই—তুই কি সব সময় আল্লাহর দিকে ফিরে থেকেছিস? না কি কখনো ভালোবাসার নামে ভুল পথ বেছে নিয়েছিস?

আমি হৃদয়ের গভীরে ঢুকে সেই অনুভূতিগুলোর জবাব খুঁজছি, যেগুলো আমাকে গড়েছে, ভেঙেছে, আবার গড়ে তুলেছে। আমি বুঝতে চাই—আল্লাহ যেই হৃদয় আমাকে দিয়েছেন, তা কি আমি তাঁর পথে ব্যয় করেছি, নাকি শুধু দুনিয়ার আবেগে হারিয়ে ফেলেছি?


## অধ্যায় ১১: আমি কী রেখে যাচ্ছি—আমার উত্তরাধিকার

এই জীবন—শুধু জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়ের পরিধি নয়, এটি এক সফর। একেকজনের সফর একেক রকম। কেউ আসে বেশিদিন থেকে, কেউ অল্প সময়েই রেখে যায় গভীর প্রভাব। কিন্তু একসময় আমাদের সবাইকেই চলে যেতে হবে। প্রশ্ন হলো, আমি কী রেখে যাচ্ছি এই পৃথিবীতে?

জীবনের পথে যা কিছু অর্জন করেছি—বাড়ি, টাকা, পদ-মর্যাদা—সবই এই দুনিয়াতেই রয়ে যাবে। এগুলো আমাদের জীবনের প্রয়োজনীয় অংশ ছিল, কিন্তু এগুলো কারো হৃদয়ে আলো জ্বালাতে পারবে না। তাই আমি গভীরভাবে ভাবি—আমার আসল উত্তরাধিকার কী?

আমি কি আমার সন্তানের মনে আল্লাহভীতির বীজ বপন করতে পেরেছি? আমি কি প্রিয়জনদের হৃদয়ে দয়া, সততা, এবং বিনয় রেখে যেতে পেরেছি? আমি কি এমন কিছু কাজ করে যেতে পেরেছি, যেগুলো আমার চলে যাওয়ার পরেও মানুষের উপকারে আসবে—একটি সদ্বাক্য, একটি হাদিয়া কুরআন, একটি শিক্ষাপ্রদ উপদেশ, বা একটি কল্যাণমূলক কাজ?

আমার সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার হোক—একটি ভালো মানুষ হয়ে যাওয়া। যে মানুষটি আল্লাহর উপর ভরসা করে, মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল, নিজের ভুল বুঝে ফিরে আসতে পারে, এবং এমন কিছু রেখে যায়, যা তার মৃত্যুর পরেও চলতে থাকে।

আমি চাই, আমার পরবর্তী প্রজন্ম যেন শুধু আমার মুখ মনে না রাখে, বরং আমার নীতি, আমার দোয়া, আমার আল্লাহর প্রতি ভালবাসা মনে রাখে। তারা যেন জানে—এই পৃথিবীতে আসা ছিল দায়িত্ব নিয়ে, আর চলে যাওয়া যেন হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি নিয়ে।

শেষ পর্যন্ত আমি রেখে যেতে চাই একটি জবাবদিহিমূলক জীবনযাত্রার নমুনা—যেখানে ইহকাল আর পরকালের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি হয়েছে।


অধ্যায় ১৮: আমার দোয়া—আমি কী কামনা করেছি আল্লাহর কাছে

জীবনের প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি সংকটে, প্রতিটি আনন্দে আমি আমার হৃদয় খুলে ডেকেছি একজনকেই—আমার প্রভু, আল্লাহ। দোয়া ছিল আমার নিরব আত্মপ্রকাশ, ছিল অভাবের আকুতি, ছিল ভালোবাসার আর্তি।

আমি দোয়া করেছি— যখন সন্তান জন্ম নিয়েছে, তার সুস্থতা ও ঈমানের জন্য। যখন স্ত্রী অসুস্থ , সুস্থতার জন্য। যখন জীবিকার টানাপোড়েনে পড়েছি, রিজিক ও সম্মানের জন্য। আমি বলেছি, “হে আল্লাহ! আমার ভুলগুলো তুমি মাফ করো, আমাকে সোজা পথে রাখো, আমার অন্তরকে ঈমানদার রাখো।”

আমি যখন দোয়া করি, তখন কেবল কিছু চাওয়া বলি না, বরং নিজের আত্মাটাকে তাঁর হাতে তুলে দিই। এবং সবশেষে শুধু এইটুকু বলি— "হে আল্লাহ! আমাকে এমন জীবন দাও, যাতে তুমি খুশি হও। আর এমন মৃত্যু দাও, যাতে তুমি আমাকে মাফ করে দাও।"


অধ্যায় ১৮: আমার আমলনামা—আমার জীবনের হিসাব

জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি দিন, প্রতিটি সিদ্ধান্ত—সবই এক একটি লিপিবদ্ধ কাজ, যা লেখা হচ্ছে আমার আমলনামায়। আমরা অনেক সময় ভুলে যাই, কিন্তু আল্লাহ কখনো ভুলেন না। “যার একটি কণার ওজন পরিমাণ কর্মও লিপিবদ্ধ হবে, আর একটি কণার ওজন পরিমাণ পাপকর্মও লেখা হবে।” (সূরা যিলযাল: ৭-৮)

আমি যখন নিজের জীবন ফিরে দেখি, তখন নিজেকে প্রশ্ন করি: আমি কী করেছি আল্লাহর জন্য? আমি কতবার অন্যকে সাহায্য করেছি নিঃস্বার্থভাবে? আমি কতবার ক্ষমা করেছি, বিনিময়ে কিছু না চেয়ে? আবার কতবার নিজের ইচ্ছা, অহংকার বা দুনিয়ার মোহে পড়ে অন্যকে কষ্ট দিয়েছি?

আমার আমলনামায় নিশ্চয়ই আছে কিছু ভালো কাজ—নিঃস্বকে সাহায্য, দুঃখীকে সান্ত্বনা, গোপনে দান, কারো গোপন দুঃখে কান্না করা। কিন্তু আছে এমন কাজও—যেগুলোর কথা আমি ভুলে গেছি, অথচ তারা আমার নামে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। হয়তো কাউকে কষ্ট দিয়েছি, কারো হক নষ্ট করেছি, হয়তো অহংকার করেছি।

এই আমলনামাই একদিন আমার মুখোমুখি হবে। কোনো অজুহাত, কোনো বাহানা সেখানে গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই আজও সুযোগ আছে, আমি চাইলে তাওবা করতে পারি, সংশোধন করতে পারি, নতুন করে শুরু করতে পারি।

আমি চাই, আমার আমলনামা এমন হোক—যেটা আমি নিজেই হাতে পেয়ে হাসতে পারি, বলি,“আলহামদুলিল্লাহ! আমার প্রভু আমার ত্রুটিগুলো ঢেকে দিয়েছেন, আর আমার ছোট ছোট ভালো কাজগুলোকেও গুণে নিয়েছেন।”


অধ্যায় ২০: আমার বিদায় ও পরকাল—এক নতুন যাত্রার শুরু

এই পৃথিবীর জীবন চিরস্থায়ী নয়। প্রতিটি আত্মারই একদিন স্বাদ নিতে হবে মৃত্যু নামক এক অজানা বাস্তবতার। আমি জানি, আমিও একদিন চলে যাবো—চোখের আলো নিভে যাবে, হৃদয়ের স্পন্দন থেমে যাবে, দেহ নিস্তব্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু আমার আত্মা? সে তো থেমে থাকবে না। সে যাত্রা শুরু করবে এমন এক জগতে, যার শুরু কবর আর শেষ জান্নাত বা জাহান্নাম।

আমি জানি না, ঠিক কবে হবে সেই দিন—সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারবো তো? আবার প্রিয়জনকে দেখতে পাবো তো? না কি, আজই আমার দুনিয়ার শেষ সকাল?

এজন্য আমি প্রতিদিন নিজেকে জিজ্ঞেস করি:

  • আমি কী তৈরি হয়েছি আমার রবের সঙ্গে দেখা করার জন্য?
  • আমার অন্তর কি তাঁর সাক্ষাতের আগ্রহে ভরে আছে?
  • আমি কি এমন কিছু রেখে যাচ্ছি, যা আমাকে মৃত্যুর পরও সওয়াব এনে দেবে?

আমি জানি, আমার জানাজায় অনেকে আসবে—কেউ কাঁদবে, কেউ চুপ থাকবে। কিন্তু মৃত্যুর পরে আমাকে একা যেতে হবে। কোনো বন্ধু, আত্মীয়, পুত্র, স্ত্রী—কেউ আমার সঙ্গে থাকবে না। থাকবে কেবল আমার আমল, আমার নিয়ত, আমার হৃদয়ের সত্যতা।

তাই আমি চাই, আমি যেন এমন কিছু রেখে যেতে পারি যা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়:

  • সদকা জারিয়া—যা অব্যাহতভাবে সওয়াব বয়ে আনবে,
  • ভালো শিক্ষা—যা অন্যদের সৎ পথে চলতে সাহায্য করবে,
  • একটি ভালো দোয়া—যা সন্তান বা কোনো প্রিয়জন আমার জন্য করে যাবে।

এই দুনিয়া ছিল একটি সফরের যাত্রা। আমি ফিরে যাচ্ছি আমার আসল ঘরে, আমার রবের কাছে। আমি দোয়া করি, আল্লাহ যেন আমাকে নিজের রহমতের চাদরে ঢেকে নেন এবং বলেন: "হে প্রশান্ত আত্মা! ফিরে এসো তোমার রবের দিকে—তুমি সন্তুষ্ট, তিনি তুমিতে সন্তুষ্ট। প্রবেশ করো আমার জান্নাতে।” (সূরা ফজর: ২৭-৩০)

কবি জালালউদ্দিন রুমি আমাদের এ উপলব্ধিকে এক গভীর আরেক রকম ভাবনায় ঋদ্ধ করে তুলেছেন, যা মৃত্যুকে ভয়ের বস্তু না ভাবিয়ে, আশার আলো হিসেবে তুলে ধরে।

- জালালউদ্দিন রুমি

যখন আমার কফিন নিয়ে যাবে, তুমি কখনো এটা ভেবোনা-
আমি এ পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছি!
চোখ থেকে অশ্রু ফেলোনা, মুষড়ে যেওনা গভীর অবসাদে কিংবা দুঃখে-
আমি পড়ে যাচ্ছি না কোন অন্তর্হীন গভীর ভয়ংকর কুয়ায়!
যখন দেখবে আমার মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে, তুমি কেঁদোনা-
আমি কোথাও যাচ্ছি না, আমি কেবল পৌঁছে যাচ্ছি অনন্ত প্রেমে।

আমাকে যখন কবরে শোয়াবে, বিদায় বলো না-
জেনো, কবর কেবল একটা পর্দা মাত্র, এটা পেরোলেই স্বর্গ।
তুমি কেবল দেখো আমাকে কবরে নামতে
এখন দেখো আমি জেগে উঠছি!
কীভাবে এটার শেষ হয় সেখানে, যখন সূর্য অস্তাচলে যায় কিংবা চাঁদ ডুবে?
এটা মনে হবে এখানেই শেষ,
অথচ এটা অনেকটা সূর্য উঠার মত, এটা বরং সুপ্রভাত
যখনই কবর ঢেকে দেয়া হবে- ঠিক তখনই তোমার আত্মা মুক্ত হবে,

তুমি কি কখনো দেখছ একটা বীজ মাটিতে বপিত হয়েছে, কিন্তু নতুনভাবে জন্মায়নি?
তাহলে তুমি কেন সন্দেহ করো- মানুষ নামের একটা বীজ জাগবে না?
তুমি কি কখনো দেখেছো, একটা বালতি কুয়ায় নামানো হয়েছে অথচ এটা খালি ফিরে এসেছে?
তাহলে তুমি কেন আহাজারি করো একটা আত্মার জন্য, যখন এটা কুয়া থেকে উঠে আসে ইউসুফের মত!\

যখন তুমি শেষবার নৈঃশব্দে ডুববে, তোমার শব্দ ও আত্মা পৌঁছে যাবে এমন এক পৃথিবীতে
যেখানে কোন স্থান নেই, সময় বলে কিছু নেই!