আমার সৃষ্টিকর্তা—আল্লাহ
In the name of Allah, the Most Gracious, the Most Merciful
আল্লাহর নামে, যিনি পরম করুণাময়, পরম দয়ালু
ভূমিকা
“তিনি সবকিছুকে সুন্দরভাবে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা সিজদা ৩২:৭)
আমি যখন ৬১ বছরে পা রেখেছি, তখন শুধু অতীত স্মৃতিই নয়, ব রং নিজের সত্ত্বার প্রতিটি পরতে পরতে আল্লাহর সৃষ্টি-সৌন্দর্য অনুভব করি। আমি এক অলৌকিক সৃষ্টি—আল্লাহর হাতে গড়া। গর্ভের একটি বিন্দু থেকে আজকের আমি—প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি হৃদস্পন্দন, আমার দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই এক একটি নিদর্শন।
এই বই শুধুই আমার জীবনের গল্প নয়, এটি এক মহাসত্যের স্বীকৃতি—আমি আল্লাহর এক অপূর্ব সৃষ্টি।
১ম অধ্যায়: জীবনের উপহার
“স্মরণ করো, যখন তোমার প্রতিপালক ফিরিশতাদের বললেন, ‘আমি মানুষ সৃষ্টি করবো কাদামাটি থেকে।’” – (সূরা সাদ, ৩৮:৭১)
আমি আজ ৬১ বছর বয়সে পা দিলাম—জীবনের এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে আমি দেখেছি সুখ-দুঃখ, আলো-আঁধারির বহু চিত্র। জন্মদিনে আমার প্রিয়জনেরা—আমার ছেলে, পুত্রবধূ, স্ত্রী এবং কাছের মানুষরা ভালোবাসা ও শুভকামনায় আমাকে ঘিরে রেখেছে, ঠিক আগের বছরের মতোই। হাসিমুখে কেক কাটা, কিছু পুরনো ছবি, ভালোবাসায় ভরা কিছু শব্দ—সব মিলিয়ে দিনটি খুব সুন্দর কেটেছে।
কিন্তু আজকের এই দিনে, সবার ভালোবাসার মাঝেও মনে হলো, আমি একটু ভাবি — আমি কে? এই আমি, যার চোখ আছে, কান আছে, হাত আছে, মন আছে — আমি কীভাবে তৈরি হলাম? কে আমাকে এমন নিখুঁতভাবে সৃষ্টি করলেন ? কীভাবে আমি ছোট্ট এক বিন্দু থেকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠলাম ?
এই দেহটা, এই মনটা, এই চিন্তাগুলো—আমি নিজে কি বানিয়েছি ? না, বরং আমি তৈরি হয়েছি এক অলৌকিক পদ্ধতিতে, এক অদৃশ্য পরিকল্পনায়, যার কারিগর হচ্ছেন আমার সৃষ্টিকর্তা—আল্লাহ।
আজ, এই বিশেষ দিনে আমি শুধু জন্মদিন নয়, নিজের সৃষ্টি দিবস নিয়েও ভাবছি । কীভাবে তিনি আমাকে এক ফোঁটা পানির বিন্দু থেকে রক্তের দলায় রূপ দিলেন, তারপর হাড়, ম াংস, চর্ম, চেতনা ও চেতনাবিহীন দেহে রূহ ফুঁকে দিলেন!
আমার শ্বাস নেওয়া, দৃষ্টি, শ্রবণ, অনুভূতি—সবই এমন কিছু, যা আমি নিজে তৈরি করিনি, চাইলেও তৈরি করতে পারতাম না। আমার জন্মও ছিল না আমার নিজের হাতে। একটি ক্ষুদ্র বিন্দু থেকে আমার অস্তিত্বের শুরু—মায়ের গর্ভে একটি অদৃশ্য প্রক্রিয়ায় আমি বৃদ্ধি পেতে থাকি। কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটি থেকে, তারপর তাকে রাখি নিরাপদ আশ্রয়ে (গর্ভে)।” – (সূরা আল-মুমিনুন, ২৩:১২-১৩)
সেই গর্ভের অন্ধকার থেকে বের হয়ে আমি আলোর মুখ দেখি, কান দিয়ে শব্দ শুনি, চামড়ার স্পর্শে শীত-গরম বুঝি। কে আমাকে এসব দিয়েছেন? আমি তো নিজেই জানি না কীভাবে আমার চোখ গঠিত হয়েছে, কীভাবে আমার হৃদয় প্রতিনিয়ত ধুকপুক করছে। তাহলে একে কাকতালীয় বলা যায় কি?
আমার দুই হাত, পাঁচ আঙুল, দুটি চোখ, হৃদয়, ফুসফুস—সবই অসাধারণভাবে কাজ করছে। যেগুলোর প্রতিটির গঠন ও কার্যপ দ্ধতি এত জটিল ও নিখুঁত, যা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীও পুরোপুরি অনুকরণ করতে পারেন না।
“তিনি তোমাদেরকে গঠন করেছেন এবং সুন্দর করেছেন তোমাদের আকৃতি।” – (সূরা আল-ইনফিতার, ৮২:৭-৮)
তাহলে আজ এই বইয়ের শুরুতেই নিজের জন্য, নিজের মতো প্রতিটি পাঠকের জন্য বলি— আমরা প্রত্যেকেই এক একটি অলৌকিক সৃষ্টি, এক একটি আল্লাহর নিদর্শন।
আমি জানি না, আগামীতে আমি কতদিন বাঁচব, কিন্তু আজ আমি জানি, আমি কেবলই একটি জীব নয়, আমি একটি উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টি। আমার দেহ, আমার চিন্তা, আমার স্মৃতি—সবই এক মহান পরিকল্পনার অংশ।
এই অধ্যায়ে আমি নিজের জীবন, দেহ এবং অস্তিত্বকে নতুন দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করছি—শুধু একজন মানুষের জীবনপথ হিসেবে নয়, বরং একে আল্লাহর দেওয়া এক অপূর্ব উপহার হিসেবে গ্রহণ করছি।
অধ্যায় ২: অদৃশ্য অন্ধকার থে কে আলোর পথে
আমার সৃষ্টি শুরু হয়েছিল এমন এক জায়গা থেকে, যেটা আমি দেখিনি, জানিনি—তবুও যার গভীর নিরবতা ও নিখুঁত পরিকল্পনার মাঝে গড়ে উঠেছিল আমার অস্তিত্ব। মা'র গর্ভ—একটি নিরাপদ অন্ধকার ঘর, যেখানে আমি ছিলাম এক বিন্দু পানির মতো, নির্ভরশীল, নিঃসহায়, অথচ আল্লাহর পরম কুদরতে গঠিত হচ্ছিলাম ধাপে ধাপে।
কোরআনে আল্লাহ বলেন: “অতঃপর আমি ওই শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তে পরিণত করি, তারপর সেই জমাট রক্তকে গোশতের দলায় রূপ দিই…” (সূরা আল-মুমিনূন: ১৪)
কি চমৎকার ছিল সেই সৃষ্টি-পর্যায়! ছোট্ট এক কোষ, তারপর একটু একটু করে হাড়, মাংস, ত্বক, চুল, চোখ—সব কিছুই গড়ে উঠলো একটি অলৌকিক ছকে। কিচ্ছু ছিল না আমার হাতে—তবুও সবকিছু হয়ে গেল যথা সময়ে, যথাযথভাবে।
আমি যখন দুনিয়ায় এলাম, তখন আমি কিছুই জানতাম না। না ভাষা, না চিন্তা, না অনুভূতি—কিন্তু আমার ভেতরে ছিল আল্লাহর দেওয়া এমন এক শক্তি, যা আমাকে শেখাবে হাঁটা, বলা, ভালোবাসা, কাঁদা, হাসা।
আজ ৬১ বছর পেরিয়ে ফিরে তাকালে মনে হয়—আমি কত অসহায় ছিলাম, আর কত দয়ার সাথে আল্লাহ আমাকে গড়ে তুলেছেন! তখন থেকেই আমি ছিলাম আল্লাহর কুদরতের এক চলমান চিহ্ন।
আমার জন্ম ছিল নিছক কোনও জৈবিক প্রক্রিয়া নয়, বরং একটি নিরব অলৌকিকতা, যা আমি এখন বুঝি—এই বয়সে এসে।