Skip to main content

007 | Al-A'raf (আল-আ'রাফ)


| আমরা সবসময় মনে রাখি | We Always Remember |

  • যখন একজন মানুষ মারা যায়, তার সব কাজ শেষ হয়ে যায় , তিনটি ব্যতিক্রম ছাড়া: সদকা জারিয়া (চলমান দান) , এমন জ্ঞান যা থেকে উপকার পাওয়া যায়, এবং একটি সৎ সন্তান যে তার জন্য দোয়া করে । | মুহাম্মদ (সাঃ) ; হাদিস - সহিহ মুসলিম | When a person dies, his works end, except for three: ongoing charity, knowledge that is benefited from, and a righteous child who prays for him. | Prophet Mohammed (PBUH); Hadith - Sahih Muslim |

  • যে ব্যক্তি ভাল কাজের জন্য সুপারিশ করবে, তার জন্য তাতে (সাওয়াবের) অংশ আছে এবং যে মন্দ কাজের জন্য সুপারিশ করবে, তার জন্য তাতে অংশ আছে । আর আল্লাহ সব কিছুর উপর নজর রাখেন । | সূরাঃ ৪ , আন-নিসা , আয়াতঃ : ৮৫ | Whoever intercedes for a good cause will have a reward therefrom; and whoever intercedes for an evil cause will have a burden therefrom. And ever is Allah, over all things, a Keeper. | Surah 4 , An-Nisa , Verse: 85 |


আয়াত সংখ্যা : ২০৬ ; মক্কায় অবতীর্ণ
Number of Verses : 206 | Revealed in Makkah


আল্লাহর নামে, যিনি পরম করুণাময়, পরম দয়ালু
In the name of Allah, the Most Gracious, the Most Merciful


আয়াত ৭ : ১ - ৫

  • আলিফ, লাম, মীম, সাদ।
  • এ কিতাব(কুরআন) আপনার প্রতি নাযিল করা হয়েছে, সুতরাং আপনার মনে যেন এ সম্পর্কে কোন সন্দেহ না থাকে। যাতে আপনি এর দ্বারা সতর্ক করতে পারেন। আর এটি মুমিনদের জন্য উপদেশ ও স্মরণিকা। [ আল্লাহ এই আয়াতে তাঁর প্রিয় নবী মুহাম্মদ ﷺ-কে বলছেন যে, এ কুরআন তাঁর প্রতি নাজিল করা হয়েছে—তাঁর অন্তরে যেন এ নিয়ে কোনো দ্বিধা, ভয় বা সংকোচ না থাকে। মুশরিকরা হয়তো উপহাস করবে, বিরোধিতা করবে, কিন্তু তাতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই কিতাব নাজিল হয়েছে দুটি উদ্দেশ্যে: একদিকে, এর মাধ্যমে মানুষকে সতর্ক করা হবে—যাতে তারা শিরক, অবাধ্যতা ও অন্যায় থেকে বিরত হয়; অন্যদিকে, মুমিনদের জন্য এটি উপদেশ, শক্তি ও স্মরণিকার কাজ করবে, যাতে তারা ঈমানের পথে দৃঢ় থাকে। অর্থাৎ, কুরআন একদিকে সতর্কবার্তা, অন্যদিকে পথপ্রদর্শক দিশারী। ]
  • তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি যা নাজিল করা হয়েছে, তোমরা তার অনুসরণ করো এবং তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো অভিভাবক বা পথপ্রদর্শকের অনুসরণ করো না। কিন্তু তোমরা অল্পই উপদেশ গ্রহণ করো। [ আল্লাহ এই আয়াতে মানুষকে স্পষ্ট নির্দেশ দিচ্ছেন যে, কেবলমাত্র তাঁর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত কিতাব—কুরআনকেই অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে অভিভাবক, পথপ্রদর্শক বা জীবনদর্শন গ্রহণ করা যাবে না, কারণ তা মানুষকে ভ্রান্তির দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু দুঃখজনক হলো—মানুষের বড় অংশই আল্লাহর এই শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং অল্প কয়েকজনই সত্যিকার উপদেশ গ্রহণ করে। এ আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রকৃত দিশা শুধু কুরআনেই রয়েছে, অন্য কোনো মতবাদ বা প্রথায় নয়। ]
  • আর এমন বহু জনপদ রয়েছে, যা আমরা ধ্বংস করে দিয়েছি। তখনই আমাদের শাস্তি তাদের উপর আপতিত হয়েছিল রাতে অথবা দুপুরে যখন তারা বিশ্রাম করছিল। [ আল্লাহ এই আয়াতে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, পূর্বে বহু জাতি ছিল যারা সত্যকে অস্বীকার করেছিল। তারা নিজেদের শক্তি ও স্বাচ্ছন্দ্যের ওপর ভরসা করত এবং আল্লাহর বার্তা অমান্য করত। কিন্তু আল্লাহর শাস্তি তাদের কাছে হঠাৎ করেই এসে পড়ে—কখনও রাতের নিস্তব্ধ ঘুমের মধ্যে, আবার কখনও দুপুরের আরাম-আয়েশের সময়ে। অর্থাৎ, আল্লাহর পাকড়াও এমন সময়ে আসে যখন মানুষ একেবারেই অপ্রস্তুত থাকে। এভাবে আল্লাহ দেখিয়ে দেন যে, অবাধ্য জাতির ধ্বংস কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই নেমে আসে, আর এতে কারও পক্ষে বাঁচার উপায় থাকে না। ]
  • অতঃপর যখন আমাদের শাস্তি তাদের উপর আপতিত হয়েছিল, তখন তাদের কথা শুধু এটিই ছিল যে, নিশ্চয় আমরা সীমালংঘন করেছি। [ আল্লাহ এখানে জানাচ্ছেন যে, যখন অবাধ্য ও সত্য অস্বীকারকারী জাতিগুলোর উপর তাঁর শাস্তি এসে পড়ে, তখন আর তাদের বলার মতো কিছুই থাকে না—তারা কেবল স্বীকার করে নেয় যে, “আমরাই ছিলাম জালিম, আমরা অন্যায় করেছি।” অর্থাৎ, তখন আর অজুহাত, অস্বীকার বা পালানোর কোনো পথ খোলা থাকে না। কিন্তু সে স্বীকারোক্তি আর কোনো উপকারে আসে না।]

আয়াত ৭ : ৬ - ১০

  • অতঃপর যাদের কাছে রাসূল পাঠানো হয়েছিল অবশ্যই তাদেরকে আমরা জিজ্ঞেস করব এবং রাসূলগণকেও অবশ্যই আমরা জিজ্ঞেস করব। [ এই আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করছেন যে, কিয়ামতের দিন দুই পক্ষের কাছেই জিজ্ঞাসাবাদ হবে। একদিকে, যাদের কাছে রাসূল পাঠানো হয়েছিল—অর্থাৎ সাধারণ মানুষ—তাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে, তারা কি আল্লাহর বার্তা গ্রহণ করেছে, নাকি অস্বীকার করেছে। অন্যদিকে, রাসূলদের কাছ থেকেও জিজ্ঞাসা করা হবে, তারা কি আল্লাহর বার্তা সঠিকভাবে পৌঁছে দিয়েছেন। এভাবে আল্লাহ ন্যায়বিচারের পূর্ণতা প্রতিষ্ঠা করবেন, যাতে কেউ বলতে না পারে—“আমরা জানতাম না।” এটি আমাদের জন্য সতর্কবার্তা যে, কুরআন ও নবীর শিক্ষা আমাদের কাছে পৌঁছেছে—এখন দায়িত্ব আমাদের উপর, আমরা তা মেনে চলি কি না।]
  • অতঃপর অবশ্যই আমরা তাদের কাছে পূর্ণ জ্ঞানের সাথে তাদের কাজগুলো বিবৃত করব, আর আমরা তো অনুপস্থিত ছিলাম না। [ আল্লাহ এই আয়াতে জানাচ্ছেন যে কিয়ামতের দিন মানুষের প্রতিটি কাজের পূর্ণ বিবরণ তাঁর সামনে হাজির করা হবে। আল্লাহ নিজেই সব জানেন, কোনো কিছুই তাঁর অগোচরে নেই। মানুষ গোপনে বা প্রকাশ্যে যা-ই করুক না কেন, সবকিছু লিপিবদ্ধ হচ্ছে এবং সেই দিন স্পষ্টভাবে তা তুলে ধরা হবে। আল্লাহর বিচার হবে পরিপূর্ণ জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে, তাই সেখানে কোনো অবিচার বা বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা কখনোই আল্লাহর দৃষ্টি থেকে আড়াল নই—তাই আমাদের প্রতিটি কাজের জন্য জবাবদিহির প্রস্তুতি নিতে হবে। ]
  • আর সেদিন পরিমাপ হবে যথাযথ। সুতরাং যাদের পাল্লা ভারি হবে তারাই হবে সফলকাম। [ কিয়ামতের দিনে মানুষের সব কাজের ওজন করা হবে ন্যায় ও সত্যের ভিত্তিতে। যে ব্যক্তির সৎকর্ম বেশি হবে এবং তার আমলনামার পাল্লা ভারী হবে, সে-ই প্রকৃত সফল হবে এবং জান্নাতের পুরস্কার লাভ করবে। এখানে বোঝানো হয়েছে, আল্লাহর বিচারে কোনো পক্ষপাত থাকবে না—শুধু ন্যায়ের ভিত্তিতেই প্রতিটি মানুষের হিসাব হবে। তাই দুনিয়ায় আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত নেক আমল বাড়ানো, যাতে আখিরাতে আমাদের পাল্লা ভারী হয়। ]
  • আর যাদের পাল্লা হালকা হবে, তারাই হবে সেই সব লোক, যারা নিজদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কারণ তারা আমাদের আয়াতসমূহকে অস্বীকার ও অবিচার করত। [ এই আয়াতে আল্লাহ বলছেন, কিয়ামতের দিনে যাদের সৎকর্মের পাল্লা হালকা হবে, তারা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনবে। কারণ তারা দুনিয়ায় আল্লাহর আয়াত অমান্য করেছে, সত্যকে অস্বীকার করেছে এবং অন্যায় কাজ করেছে। ফলে আখিরাতে তাদের জন্য কোনো মুক্তি বা সাফল্য নেই। এখানে শিক্ষা হলো—যারা দুনিয়ায় আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে গাফেল থাকে, তারা আসলে নিজেদের ক্ষতিই করে; আর যারা আল্লাহর প্রতি আনুগত্য করে, তারাই প্রকৃত সফলকাম। ]
  • আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পৃথিবীতে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ দিয়েছি এবং তোমাদের জীবিকার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু তোমরা খুব সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। [ এই আয়াতে আল্লাহ মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি মানুষকে পৃথিবীতে বসবাসের সুযোগ দিয়েছেন এবং জীবনযাপনের সব প্রয়োজনীয় উপকরণ সাজিয়ে দিয়েছেন—খাদ্য, পানি, আশ্রয়, রোদ-বৃষ্টি, ফসল ও জীবিকার নানা ব্যবস্থা। সবকিছুই আল্লাহর দান, কিন্তু মানুষ খুব কমই এর জন্য সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এই আয়াত আমাদের শিক্ষা দেয়—আমাদের প্রতিদিনের জীবনে যে নেয়ামতগুলো আমরা ভোগ করি, সেগুলোকে অবহেলা না করে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে হবে। ]

আয়াত ৭ : ১১ - ১৫

  • আর অবশ্যই আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, তারপর আমরা তোমাদের আকৃতি প্রদান করেছি, তারপর আমরা ফিরিশতাদেরকে বললাম, আদমকে সিজদা কর। অতঃপর ইবলীস ছাড়া সবাই সিজদা করল। সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হল না। [ আল্লাহ এই আয়াতে মানুষকে তাদের মূল সৃষ্টি সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। তিনি প্রথমে আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করলেন এবং সুন্দর আকার-আকৃতি দিলেন। এরপর আল্লাহ ফেরেশতাদের নির্দেশ দিলেন আদমের সামনে সিজদা করতে, যা ছিল সম্মান প্রদর্শনের প্রতীক। সব ফেরেশতাই আল্লাহর আদেশ মেনে সিজদা করল, কিন্তু ইবলিস অহংকার করে অস্বীকার করল। এই ঘটনার মাধ্যমে বোঝানো হয়—মানুষ আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টি, আর অহংকারই হলো ইবলিসের ধ্বংসের মূল কারণ। ]
  • (আল্লাহ) বললেন: আমি যখন তোমাকে আদেশ করলাম, তখন কী কারণে তুমি সিজদা করলে না? (ইবলিস) বলল: আমি তো তার চেয়ে উত্তম। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি দ্বারা । [ আল্লাহ ইবলিসকে প্রশ্ন করলেন কেন সে আদমকে সিজদা করতে অস্বীকার করল, যদিও এটি ছিল আল্লাহর সরাসরি নির্দেশ। জবাবে ইবলিস বলল যে সে আদমের চেয়ে উত্তম, কারণ তাকে আগুন থেকে আর আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে ইবলিসের অহংকার ও গোঁড়ামি প্রকাশ পেয়েছে—সে ভেবেছিল উপাদানের দিক থেকে তার শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে, অথচ আসল শ্রেষ্ঠত্ব হলো আনুগত্য ও বিনয়। এই আয়াত আমাদের শেখায় যে, অহংকার মানুষকে (বা জিনকে) আল্লাহর আদেশ অমান্য করতে প্ররোচিত করে এবং শেষ পর্যন্ত ধ্বংস ডেকে আনে। ]
  • (আল্লাহ) বললেন: তাহলে তুমি এখান থেকে নেমে যাও, এখানে থেকে অহংকার করবে, এটা হতে পারে না। সুতরাং তুমি বের হয়ে যাও, নিশ্চয় তুমি অধমদের অন্তর্ভুক্ত ।
  • (ইবলিস) বলল: আমাকে সেই দিন পর্যন্ত অবকাশ দিন, যেদিন তাদেরকে পুনরুজ্জীবিত করা হবে । [ ইবলিস আল্লাহর কাছে অনুরোধ করেছিল, আমাকে সেই দিন পর্যন্ত সময় দাও, যখন মানুষ পুনরুত্থিত হবে। ইবলিসের উদ্দেশ্য সেই সময়ের মধ্যে মানুষকে পথভ্রষ্ট করা এবং তাদের ধ্বংসের পরিকল্পনা করা। এটি আমাদের শেখায় যে শয়তান সর্বদা মানুষের প্রতি সক্রিয় থাকে এবং সময় পেলে তাদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। তাই মুমিনদের জন্য সতর্ক থাকা জরুরি, আল্লাহর আস্থায় স্থির থাকা এবং শয়তানের প্রলোভন থেকে নিজেদের রক্ষা করা। ]
  • (আল্লাহ) বললেন: নিশ্চয় তুমি অবকাশপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত । [ এই আয়াতে আল্লাহ ইবলিসকে বলেন যে, তাকে অবশ্যই একটি সময় পর্যন্ত অবকাশ দেওয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ইবলিস মানুষকে প্রলোভিত করার চেষ্টা করতে পারবে, কিন্তু এটি সীমাবদ্ধ এবং আল্লাহর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। আয়াতটি আমাদের শেখায় যে, আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেন নির্দিষ্ট নিয়ম ও পরিকল্পনা অনুযায়ী, আর শয়তানকে কেবল সীমিত সময়ের জন্য মানুষের পরীক্ষা করার সুযোগ দেওয়া হয়। মুমিনদের জন্য শিক্ষা হলো—শয়তানের চক্রান্ত ও প্রলোভনের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা এবং আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস বজায় রাখা। ]

আয়াত ৭ : ১৬ - ২০

  • (ইবলিস) বলল: আপনি যেহেতু আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, তাই আমি অবশ্যই তাদের জন্য আপনার সরল পথের ওপর বসে থাকব । [ এই আয়াতে ইবলিস তার কৌশল প্রকাশ করছে। সে বলল, আল্লাহ যেহেতু তাকে অবকাশ দিয়েছেন, তাই সে মানুষের সামনে আল্লাহর সরল পথকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য বসে থাকবে। অর্থাৎ মানুষ যখন সৎপথে চলতে চাইবে, তখন সে নানা প্রলোভন, সন্দেহ, অহংকার ও কুমন্ত্রণা দিয়ে তাদেরকে পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করবে। এখানে শিক্ষা হলো—শয়তান কখনো আল্লাহকে অস্বীকার করেনি, বরং আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করেও সে বিদ্রোহ করেছিল। আর আজও তার প্রধান কাজ হলো মানুষকে সোজা পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া। তাই মুমিনদের জন্য সতর্ক থাকা জরুরি, যাতে তারা আল্লাহর দিকনির্দেশনা আঁকড়ে ধরে শয়তানের ফাঁদে না পড়ে। ]
  • তারপর আমি অবশ্যই তাদের কাছে আসব তাদের সামনে থেকে, তাদের পেছন থেকে, তাদের ডান দিক থেকে এবং তাদের বাম দিক থেকে। আর আপনি তাদের অধিকাংশকেই কৃতজ্ঞ পাবেন না। [ এখানে ইবলিস ঘোষণা করেছে যে, সে মানুষকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলবে—সামনের দিক থেকে তাদেরকে ভবিষ্যতের লোভ-লালসায় ব্যস্ত করবে, পেছনের দিক থেকে অতীতের পাপের দিকে ফিরিয়ে নেবে, ডান দিক থেকে নেক আমল নষ্ট করার চেষ্টা করবে এবং বাম দিক থেকে মন্দ কাজে আকৃষ্ট করবে। তার আসল লক্ষ্য হলো মানুষকে আল্লাহর নেয়ামত ভুলিয়ে দেওয়া, যাতে তারা অকৃতজ্ঞ হয়ে পড়ে এবং কৃতজ্ঞ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত না হয়। এ আয়াত আমাদের সাবধান করে যে, শয়তান সর্বদা মানুষের চারপাশে ফাঁদ পাতছে। তাই মুক্তির একমাত্র উপায় হলো আল্লাহর স্মরণে দৃঢ় থাকা ও কৃতজ্ঞতায় অবিচল থাকা।]
  • আল্লাহ বললেন: তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও লাঞ্ছিত ও বিতাড়িত হয়ে। আর তাদের মধ্যে যে কেউ তোমার অনুসরণ করবে, আমি অবশ্যই তোমাদের সবাইকে একসাথে জাহান্নাম দিয়ে পূর্ণ করব। [ আল্লাহ ইবলিসকে অপমানিত করে জান্নাত থেকে বের করে দিলেন এবং স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে, মানুষ যদি তার পথ অনুসরণ করে, তবে তাদের পরিণতিও হবে জাহান্নাম। অর্থাৎ, শয়তান শুধু নিজেই ধ্বংসের পথে যায়নি, বরং যে কেউ তার ধোঁকা ও প্রলোভনে পড়ে আল্লাহর অবাধ্য হবে, সেও একই পরিণতির শিকার হবে। এ আয়াত আমাদের সতর্ক করে যে, শয়তানের ফাঁদে পা দিলে শেষ গন্তব্য হবে জাহান্নাম। তাই আমাদের জন্য একমাত্র নিরাপদ পথ হলো আল্লাহর আনুগত্য করা ও তাঁর নির্দেশ মেনে চলা। ]
  • আর হে আদম! আপনি ও আপনার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করুন, অতঃপর সেখানে যেখানে ইচ্ছা সেখান থেকে খান, কিন্তু এ গাছের ধারে-কাছেও যাবেন না, তাহলে আপনারা সীমালঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। [ আল্লাহ হজরত আদম (আ.) এবং তাঁর স্ত্রী হাওয়াকে জান্নাতে থাকার অনুমতি দিলেন। সেখানে তাদের জন্য সবকিছু ভোগ করার সুযোগ দেওয়া হলো। তবে একটি পরীক্ষার জন্য আল্লাহ বিশেষভাবে সতর্ক করলেন—একটি নির্দিষ্ট গাছের কাছে যেতে বা তা থেকে খেতে নিষেধ করলেন। যদি তারা এ নির্দেশ অমান্য করে, তবে তারা নিজেদের ক্ষতি করবে এবং অন্যায়কারীর দলে গণ্য হবে। ]
  • তারপর তাদের লজ্জাস্থান, যা তাদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল তা তাদের কাছে প্রকাশ করার জন্য শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, পাছে তোমরা উভয়ে ফিরিশতা হয়ে যাও কিংবা তোমরা (জান্নাতে) চিরস্থায়ী হও, এ জন্যই তোমাদের প্রতিপালক এ বৃক্ষ সম্বন্ধে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন। [ শয়তান আদম (আ.) ও হাওয়ার মনে কুমন্ত্রণা জাগিয়ে দিল, যেন তাদের সেই গোপন দিক প্রকাশ পায় যা আগে তাদের কাছে অদৃশ্য ছিল। সে তাদের প্রলুব্ধ করে বলল, “আল্লাহ কেবল এ কারণে তোমাদের এই গাছ থেকে খেতে বারণ করেছেন—যাতে তোমরা ফেরেশতা না হয়ে যাও, কিংবা অনন্ত জীবন লাভ না কর।” এভাবে শয়তান তাদের মনে ভ্রান্ত আশা সৃষ্টি করল, যাতে তারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করতে প্রলুব্ধ হয়। ]

আয়াত ৭ : ২১ - ২৫

  • আর সে তাদের উভয়ের কাছে শপথ করে বলল, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের শুভাকাংখীদের একজন।
  • অতঃপর সে তাদেরকে প্রবঞ্চনার দ্বার অধঃপতিত করল। এরপর যখন তারা সেই বৃক্ষের আস্বাদ গ্রহণ করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের নিকট প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং তারা জান্নাতের পাতা দিয়ে নিজেদেরকে আবৃত করতে লাগল। তখন তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষ সম্বন্ধে সাবধান করিনি এবং শয়তান যে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু, তা আমি কি তোমাদেরকে বলিনি ?
  • তারা বলল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি। যদি তুমি আমাদেরকে ক্ষমা না কর, তাহলে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।
  • আল্লাহ বললেন, তোমরা নেমে যাও, তোমরা একে অন্যের শক্র এবং যমীনে কিছুদিনের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল।
  • বললেন, সেখানেই তোমরা জীবন যাপন করবে এবং সেখানেই তোমরা মারা যাবে। আর সেখান থেকেই তোমাদেরকে বের করা হবে।

আয়াত ৭ : ২৬ - ৩০

  • হে বনী আদম! অবশ্যই আমরা তোমাদের জন্য পোষাক নাযিল করেছি, তোমাদের লজ্জাস্থান ঢাকা ও বেশ-ভূষার জন্য। আর তাকওয়ার পোষাক, এটাই সর্বোত্তম। এটা আল্লাহ্‌র নিদর্শনসমূহের অন্যতম, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে। [ আল্লাহ মানুষকে পোশাক দিয়েছেন, যা তাদের লজ্জাস্থান ঢেকে রাখে এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পোশাক হলো তাকওয়া—আল্লাহভীরুতা ও নৈতিকতা। এটি মানুষকে অভ্যন্তরীণভাবে সুন্দর করে এবং সঠিক পথ অনুসরণের জন্য সাহায্য করে। এই আয়াত আমাদের শেখায় যে, বাহ্যিক সৌন্দর্যই যথেষ্ট নয়; আল্লাহভীরুতা ও নৈতিক জীবনই প্রকৃত মূল্য। ]
  • হে বনী আদম! শয়তান যেন তোমাদেরকে কিছুতেই প্রলুব্ধ না করে যেভাবে সে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল, সে তাদেরকে তাদের লজ্জাস্থান দেখাবার জন্য বিবস্ত্র করেছিল৷ নিশ্চয় সে নিজে এবং তার দল তোমাদেরকে এমনভাবে দেখে যে, তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। নিশ্চয় আমরা শয়তানকে তাদের অভিভাবক করেছি, যারা ঈমান আনে না। [ আল্লাহ আমাদের সতর্ক করছেন যে, শয়তান যেন আমাদের প্রলুব্ধ না করতে পারে, যেমন তিনি আদম (আ.) ও হাওয়াকে জান্নাত থেকে বের করতে প্রলুব্ধ করেছিলেন। শয়তান তাদের পোশাক বিবস্ত্র করে লজ্জাস্থান প্রকাশ করেছিল। শয়তান ও তার দল মানুষকে এমনভাবে ঘিরে রাখে, যেখানে আমরা তাদের দেখতে পারি না। আয়াতটি আমাদের শিক্ষা দেয়, শয়তানের ফাঁদ থেকে বাঁচতে আমাদের সতর্ক থাকা এবং আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা অত্যাবশ্যক। ]
  • আর যখন তারা কোন অশ্লীল আচরণ করে তখন বলে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এতে পেয়েছি এবং আল্লাহও আমাদেরকে এরই নির্দেশ দিয়েছেন। বলুন, আল্লাহ অশ্লীলতার নির্দেশ দেন না। তোমরা কি আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কিছু বলছ যা তোমরা জান না। [ ইসলামের আগের সময় মুশরিকরা উলঙ্গ অবস্থায় কাবা তাওয়াফ করত। তারা দাবি করত, “আমরা সেই অবস্থায় তাওয়াফ করি, যেভাবে আমাদের মা আমাদের প্রসব করেছিলেন।” কেউ আবার বলত, “আমরা যে পোশাক পরে আছি, তাতে আমরা আল্লাহর অনুশাসন অমান্য করি; তাই পোশাক খুলে তাওয়াফ করা উচিত।” মহিলারাও উলঙ্গভাবে তাওয়াফ করত, কেবল নিজেদের লজ্জাস্থানের একটি ছোট কাপড় বা চামড়ার টুকরা ঢেকে রাখত। তারা এই আচরণের জন্য আরও দুটি ওজুহাত প্রস্তাব করত—এক, “আমাদের পূর্বপুরুষ এভাবেই করত।” দুই, “আল্লাহই আমাদের এটি করার নির্দেশ দিয়েছেন।” আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে এই যুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, তিনি কখনোই নির্লজ্জতার নির্দেশ দেননি। অর্থাৎ, তারা আল্লাহর নামে এমন কিছু দাবি করছে, যা তিনি বলেননি। এই আয়াত সেইসব অন্ধ অনুকরণকারীদের কঠোরভাবে তিরস্কার করে, যারা পূর্বপুরুষ, পীর বা শায়খের অন্ধ অনুকরণ এবং ব্যক্তিপূজায় আবদ্ধ। তারা যখন সঠিক দিক দেখানো হয়, তখনও পুরনো প্রথা বা বিদআতের পিছনে লেগে থাকে। ]
  • বলুন, আমার রব নির্দেশ দিয়েছেন ন্যায়বিচারের। আর তোমরা প্রত্যেক সাজদাহ বা ইবাদতে তোমাদের লক্ষ্য একমাত্র আল্লাহকেই নির্ধারণ কর এবং তারই আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাকে ডাক। তিনি যেভাবে তোমাদেরকে প্রথমে সৃষ্টি করেছেন তোমরা সেভাবে ফিরে আসবে। [ এই আয়াতে আল্লাহ মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি সবসময় ন্যায়পরায়ণতা পছন্দ করেন এবং তাঁর বান্দাদেরও ন্যায় ও সত্যের পথে চলতে নির্দেশ দিয়েছেন। নামাজ আদায় করার সময় শুধু শারীরিকভাবে নয়, বরং মন-প্রাণ সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর দিকে মনোযোগী হতে হবে। ইবাদত এমন হতে হবে যেখানে ভণ্ডামি বা অন্য কারও উদ্দেশ্য থাকবে না—বরং খাঁটি নিয়তে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হবে। শেষে আয়াতে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, যেমন আল্লাহ মানুষকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন, তেমনি একদিন তিনি আবার সকলকে পুনরুত্থিত করবেন এবং সবাইকে তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে। ]
  • আল্লাহ এক দলকে সৎ পথে পরিচালিত করেছেন এবং অপর দলের জন্য সংগত কারণেই ভ্রান্তি নির্ধারিত হয়েছে,তারা আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানকে তাদের অভিভাবক-রূপে গ্রহণ করেছিল এবং মনে করত তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত। [ এই আয়াতে আল্লাহ মানুষকে দুই দলে ভাগ করেছেন—একদল সঠিক পথ পেয়েছে, কারণ তারা আল্লাহর নির্দেশ মানে এবং তাঁর একত্ববাদে বিশ্বাস করে। অন্যদল ভ্রষ্টতার মধ্যে পড়ে গেছে, কারণ তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে শয়তানকে অনুসরণ করেছে এবং তাকে বন্ধু বা অভিভাবক বানিয়েছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো—ভ্রষ্টরা মনে করে তারাই সঠিক পথে আছে। অর্থাৎ তারা ভুলকে ঠিক মনে করে বসে থাকে। এভাবেই মানুষ বিভ্রান্ত হয়, যখন সত্যকে ছেড়ে মিথ্যার পেছনে ছুটে। ]

আয়াত ৭ : ৩১ - ৩৫

  • হে আদম সন্তান! প্রত্যেক সালাতের সময় তোমরা তোমাদের শোভা-সজ্জা (পরিচ্ছন্ন পোশাক) । আর খাও ও পান করো, কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না। [ এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণও হল মুশরিকদের উলঙ্গ তাওয়াফ করা। তাই তাদেরকে বলা হল, পোশাক পরে আল্লাহর ইবাদত ও তাওয়াফ কর। এই আয়াতে আল্লাহ আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে নামাজ শুধু ইবাদত নয়, বরং পরিচ্ছন্নতা ও শালীনতার সাথেও সম্পর্কিত। তাই নামাজ পড়তে গেলে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও শোভন পোশাক পরা উচিত। আবার আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত—খাবার ও পানীয়—আমরা উপভোগ করব, এতে কোনো বাধা নেই। তবে শর্ত হলো, যেন অপচয় না হয়। কারণ আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না। অতিরিক্ত খাওয়া, অযথা ব্যয় করা বা প্রয়োজনের বাইরে ভোগ-বিলাস সবই অপছন্দনীয় কাজ। তাই এ আয়াত আমাদের শেখায়—জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। ]
  • বলুন, কে আল্লাহর সেই শোভা-সজ্জা হারাম করেছে যা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন এবং উত্তম জীবিকা? বলুন, এগুলো দুনিয়ার জীবনে মুমিনদের জন্য, আর কিয়ামতের দিন কেবলমাত্র তাদের জন্য হবে। এভাবেই আমি জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আয়াতগুলো সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করি। [ মুশরিকরা কাবা শরীফে তাওয়াফ করার সময় পোশাক পরিধান করাকে অপছন্দ করত। তারা মনে করত, আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে হলে নিরস্ত্র বা অর্ধনগ্ন হয়ে তাওয়াফ করা শ্রেয়। একইভাবে অনেক হালাল জিনিসকেও তারা নিজেদের খেয়াল-খুশি বা ধর্মীয় ভ্রান্ত ধারণার কারণে হারাম ঘোষণা করেছিল। আবার অনেক বৈধ জিনিসকে প্রতিমাদের নামে উৎসর্গ করার ফলে সেগুলোও তাদের কাছে হারাম হয়ে যেত। অথচ আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলে দিলেন—মানুষের সাজ-সজ্জার জন্য পোশাক ও পানাহারের জন্য উৎকৃষ্ট খাদ্য-পানীয় তিনি নিজেই বানিয়েছেন। এগুলোকে হারাম করার অধিকার কারও নেই। মানুষের মনগড়া নিষেধাজ্ঞার কারণে আল্লাহর হালাল করা কোনো কিছু হারাম হয়ে যাবে না।
    আল্লাহর দানকৃত এই সব নেয়ামত আসলে ঈমানদারদের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। যদিও দুনিয়ার জীবনে কাফেররাও এগুলো থেকে উপকারিতা ও ভোগ-তৃপ্তি পায়, এমনকি অনেক সময় সম্পদ ও ভোগ-বিলাসের ক্ষেত্রে মুসলমানদের চেয়েও এগিয়ে থাকে। কিন্তু এগুলো কেবল সাময়িক এবং পরীক্ষার অংশ। কিয়ামতের দিন এ সব হালাল ও পবিত্র নিয়ামত কেবল ঈমানদারদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। যেমনভাবে কাফেরদের জন্য জান্নাত চিরতরে হারাম হবে, তেমনি জান্নাতের যাবতীয় খাদ্য-পানীয়ও তাদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। ]
  • বলুন, আমার প্রতিপালক হারাম করেছেন অশ্লীল কাজসমূহ—তা প্রকাশ্য হোক কিংবা গোপন, পাপাচার, অন্যায়ভাবে জুলুম করা, আল্লাহর সাথে এমন কাউকে শরীক করা যার ব্যাপারে তিনি কোনো প্রমাণ নাজিল করেননি এবং আল্লাহ সম্পর্কে এমন কথা বলা যার কোনো জ্ঞান তোমাদের নেই। [ এই আয়াতে আল্লাহ স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, আসল হারাম কী কী। মানুষের বানানো মিথ্যা নিয়ম নয়, বরং আল্লাহ নিজেই নির্ধারণ করেছেন হারামের সীমা। তিনি হারাম করেছেন সব ধরনের অশ্লীলতা—খোলাখুলি হোক বা গোপনে। তিনি হারাম করেছেন সকল পাপ এবং অন্যায়ের মাধ্যমে মানুষের ওপর জুলুম করা। সবচেয়ে বড় হারাম হলো আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, কারণ এর কোনো প্রমাণ বা অনুমতি আল্লাহ দেননি। আরেকটি গুরুতর হারাম হলো আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলা—যেমন নিজের মনগড়া হালাল-হারাম তৈরি করা বা আল্লাহর নামে এমন কথা বলা যার সত্যতা জানা নেই। এই আয়াত মানুষের জন্য একটি স্পষ্ট নীতিমালা: হারাম ও হালাল নির্ধারণের অধিকার কেবল আল্লাহরই। ]
  • আর প্রত্যেক জাতির জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। যখন তাদের সেই নির্দিষ্ট সময় এসে যায়, তখন তারা এক মুহূর্তও তা পিছিয়ে দিতে পারে না এবং এগিয়ে আনতেও পারে না। [ আল্লাহ এই আয়াতে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, পৃথিবীতে প্রতিটি জাতি ও সম্প্রদায়ের জন্য নির্দিষ্ট একটি সময়সীমা নির্ধারিত আছে। তাদের উন্নতি, পতন ও অবসানের জন্য আল্লাহর নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত রয়েছে। যখন সেই সময় উপস্থিত হবে, তখন তারা এক মুহূর্তও তা বিলম্ব করতে পারবে না, আবার এগিয়ে আনতেও পারবে না। অর্থাৎ কোনো জাতি বা ব্যক্তি আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর থেকে সামান্যতমও এদিক-সেদিক হতে পারবে না। এতে বোঝা যায়—মানবজাতির জীবন, মৃত্যু ও ইতিহাস সবই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে এবং মানুষকে সবসময় তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ]
  • হে আদম সন্তান! তোমাদের নিকট যদি এমন রাসূলগণ আসেন, যারা তোমাদের মধ্য থেকেই হবে এবং আমার আয়াতসমূহ তোমাদের কাছে পৌঁছে দেবে, তবে যারা তাকওয়া অবলম্বন করবে এবং নিজেদের সংশোধন করবে, তাদের কোনো ভয় থাকবে না এবং তারা দুঃখিতও হবে না। [ আল্লাহ এ আয়াতে সমগ্র মানবজাতিকে সম্বোধন করে বলেছেন—তোমাদের কাছে সময়ে সময়ে রাসূল আসবে, যারা তোমাদের মধ্য থেকেই হবে এবং আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেবে। রাসূলদের দায়িত্ব হলো আল্লাহর নির্দেশনা মানুষকে জানানো। এরপর মানুষের দায়িত্ব হলো সেই আহ্বানে সাড়া দেওয়া। যারা আল্লাহকে ভয় করে (তাকওয়া অর্জন করে) এবং নিজেদের জীবনকে সংশোধন করে নেয়, তারা পরকালে নিরাপদ থাকবে। তাদের জন্য কোনো ভয় নেই—ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্ক নেই, অতীত নিয়েও দুঃখ নেই। তারা আল্লাহর রহমত ও শান্তির অধিকারী হবে।]

আয়াত ৭ : ৩৬ - ৪০

  • আর যারা আমার আয়াতগুলোকে অস্বীকার করবে আর সেগুলোর ব্যাপারে ঔদ্ধত্য দেখাবে, তারাই হল জাহান্নামের বাসিন্দা, তাতে তারা চিরকাল থাকবে। [ এই আয়াতে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেন, যারা তাঁর আয়াত অস্বীকার করবে এবং অবিশ্বাসী হবে, তাদের জন্য কঠিন ফলাফল অপেক্ষা করছে। তারা কেবল সাময়িকভাবে নয়, বরং চিরকাল আগুনে দগ্ধ হবে। এই আয়াত আমাদের সতর্ক করে—আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলাই নিরাপদ জীবন ও পরকালের শান্তির একমাত্র পথ। ]
  • সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রটনা করে কিংবা তার আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে তার চেয়ে বড় যালিম আর কে? তাদের জন্য যে অংশ লেখা আছে তা তাদের কাছে পৌছবে । অবশেষে যখন আমাদের ফিরিশতাগণ তাদের জান কবজের জন্য তাদের কাছে আসবে, তখন তারা জিজ্ঞেস করবে, আল্লাহ্‌ ছাড়া যাদেরকে তোমরা ডাকতে তারা কোথায়? তারা বলবে, তারা আমাদের কাছ থেকে উধাও হয়েছে এবং তারা নিজেদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে যে, নিশ্চয় তারা কাফের ছিল।
  • আল্লাহ্ বলবেন, তোমাদের আগে যে জিন ও মানবদল গত হয়েছে তাদের সাথে তোমরা দোযখে প্রবেশ কর। যখনই কোন দল তাতে প্রবেশ করবে তখনই অন্য দলকে তারা অভিসম্পাত করবে। অবশেষে যখন সবাই তাতে একত্র হবে তখন তাদের পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের সম্পর্কে বলবে, হে আমাদের রব! এরাই আমাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল; কাজেই এদেরকে দোযখের দ্বিগুণ শাস্তি দিন। আল্লাহ বলবেন, প্রত্যেকের জন্য দ্বিগুণ রয়েছে, কিন্তু তোমরা জান না। [ যখনই কোনো ধর্মাবলম্বী জাহান্নামে প্রবেশ করবে, তখন সে তার ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যারা আগে প্রবেশ করেছে তাদেরকে অভিসম্পাত করবে। অর্থাৎ, মুশরিকরা মুশরিকদেরকে, ইয়াহূদীরা ইয়াহূদীদেরকে, নাসারারা নাসারাদেরকে, সাবেয়ীরা সাবেয়ীদেরকে, অগ্নিউপাসকরা অগ্নিউপাসকদের অভিসম্পাত দেবে। এভাবে পরবর্তী প্রবেশকারীরা পূর্ববর্তীদের অভিসম্পাত করবে। - [তাবারী]]
  • আর তাদের পূর্ববর্তীরা পরবর্তীদেরকে বলবে, আমাদের উপর তোমাদের কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কাজেই তোমরা যা অর্জন করেছিলে, তার জন্য শাস্তি ভোগ কর।
  • নিশ্চয় যারা আমাদের আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করে এবং তা সম্বন্ধে অহংকার করে তাদের জন্য আকাশের দরজা খোলা হবে না এবং তারা জান্নাতেও প্রবেশ করতে পারবে না - যতক্ষন না সূঁচের ছিদ্র দিয়ে উট প্রবেশ করে। আর এভাবেই আমরা অপরাধীদেরকে প্রতিফল দেব। [ এই আয়াতে আল্লাহ বলেন, যারা তাঁর আয়াত অস্বীকার করেছে এবং তা নিয়ে অহংকার করেছে, তাদের জন্য জান্নাতের দরজা বন্ধ। তারা কখনো জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আয়াতটি একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছে—যেমন, সূচের ছিদ্রে উট প্রবেশ করা অসম্ভব, ঠিক তেমনি কাফেরদের জান্নাতে প্রবেশও অসম্ভব। এখানে উটের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে, কারণ তা আরবদের কাছে পরিচিত এবং আকারে বড়। আর সূচের ছিদ্র এত সূক্ষ্ণ ও সংকীর্ণ যে এতে কিছু প্রবেশ করা সম্ভব নয়। এই উদাহরণ ব্যবহার করে আল্লাহ অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন, “অসম্ভব জিনিসের সাথে শর্ত” মানে এমন কিছু যা ঘটতেই পারে না। তাই, উটের সূচের ছিদ্রে প্রবেশের মতো অসম্ভবতা দিয়ে বোঝানো হয়েছে যে অহংকারী কাফেরদের জন্য জান্নাতে প্রবেশ চিরতরে অসম্ভব।]

আয়াত ৭ : ৪১ - ৪৫

  • তাদের শয্যা হবে জাহান্নামের এবং তাদের উপরের আচ্ছাদনও; আর এভাবেই আমরা যালিমদেরকে প্রতিফল দেব । [ এই আয়াতে আল্লাহ জানাচ্ছেন, কাফের ও জালিমদের জন্য জাহান্নামের ভয়াবহ অবস্থা কেমন হবে। তাদের নিচে থাকবে আগুনের বিছানা, আর উপরে থাকবে আগুনের আচ্ছাদন। অর্থাৎ, তারা চারদিক থেকে আগুন দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকবে—কোনো দিকেই পালানোর বা আশ্রয় নেয়ার সুযোগ থাকবে না। ]
  • আর যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে — এমন কোন ব্যক্তিকে আমি তার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দেইনা - তারাই হবে জান্নাতবাসী, সেখানে তারা চিরকাল অবস্থান করবে । [ এই আয়াতে আল্লাহ বলেন, যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্য জান্নাত নিশ্চিত। আল্লাহ কাউকে এমন দায়িত্ব দেন না যা তার সাধ্যের বাইরে। তাই কারো জন্য ঈমান আনা ও সৎকর্ম করা কঠিন নয়। যারা সত্যিকারভাবে চেষ্টা করবে, তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং সেখানে চিরদিনের জন্য থাকবে। ]
  • আর আমরা তাদের অন্তর থেকে সব বিদ্বেষ দূর করে দেব। তাদের নিচ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত হবে। তারা বলবে, “সব প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে এ পথে পরিচালিত করেছেন। যদি আল্লাহ আমাদের পথপ্রদর্শন না করতেন, তবে আমরা কখনো সঠিক পথ পেতাম না। আমাদের প্রভুর রসূলগণ অবশ্যই সত্য বার্তা নিয়ে এসেছিলেন।” আর তাদের ডেকে বলা হবে, “এটাই সেই জান্নাত, যা তোমরা তোমাদের কর্মের কারণে উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করলে।” [ এই আয়াতে আল্লাহ জানাচ্ছেন, জান্নাতে প্রবেশের পর মুমিনদের অন্তর থেকে হিংসা, বিদ্বেষ ও বিরূপতা সম্পূর্ণভাবে মুছে যাবে। তারা হবে পরিপূর্ণ শান্তি ও ভালোবাসায় ভরা। জান্নাতে তাদের নিচ দিয়ে নদী প্রবাহিত হবে এবং তারা আনন্দের সাথে ঘোষণা করবে—“সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদের হেদায়েত দিয়েছেন। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আমরা কখনো সঠিক পথ খুঁজে পেতাম না। সত্যিই, আমাদের কাছে পাঠানো রাসূলগণ সত্য বার্তা নিয়ে এসেছিলেন।” তখন জান্নাতীদের জানিয়ে দেওয়া হবে, “এটাই সেই জান্নাত, যা তোমরা তোমাদের সৎকর্মের ফলস্বরূপ উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছো।” ]
  • জান্নাতবাসীরা জাহান্নামবাসীদেরকে ডাক দিয়ে বলবে, “আমরা তো আমাদের প্রতিপালকের দেয়া প্রতিশ্রুতিকে সত্য বলে পেয়েছি। তোমরাও কি তোমাদের প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতিকে সত্য বলে পেয়েছো?” তারা বলবে, “হ্যাঁ।” তখন তাদের মধ্যে একজন ঘোষক ঘোষণা করবে— “আল্লাহর অভিশাপ অত্যাচারীদের উপর।”
  • যারা আল্লাহর পথেপ্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত এবং তাতে বক্রতা অনুসন্ধান করত তারা পরকালকেও অস্বীকার করত।

আয়াত ৭ : ৪৬ - ৫০

  • আর তাদের উভয়ের মধ্যে পর্দা থাকবে। আর আ’রাফে কিছু লোক থাকবে, যারা প্রত্যেককে তার চিহ্ন দ্বারা চিনবে । আর তারা জান্নাতবাসীদেরকে সম্বোধন করে বলবে, তোমাদের উপর সালাম তারা তখনো জান্নাতে প্রবেশ করেনি, কিন্তু আকাংখা করে।

[ আ‘রাফ মানে হলো — উঁচু স্থান বা প্রাচীর, যা জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে থাকবে। সেখানে কিছু মানুষ অবস্থান করবে। আ’রাফবাসী কারা হবে? তাফসিরে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়:

  • যাদের সৎকর্ম ও অসৎকর্ম সমান হয়েছে
    • ইবন কাসীর, কুরতুবি, তাবারী প্রমুখ মুফাসসিররা বলেছেন: আ‘রাফের লোকেরা তারা, যাদের আমলনামায় ভালো কাজ ও খারাপ কাজ সমান থাকবে।
      • তাদেরকে জাহান্নামে পাঠানো হবে না,
      • আবার প্রথমেই জান্নাতেও প্রবেশ করানো হবে না।
      • তারা অপেক্ষায় থাকবে—আল্লাহর করুণার আশায়।
  • শহীদ, নবী বা মহান ব্যক্তিরা
    • কিছু আলেমের মতে, তারা জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে থেকে মানুষদের চিনবে এবং তাদের অবস্থা দেখবে।
    • তারা চিহ্ন দ্বারা বুঝতে পারবে কে জান্নাতি আর কে জাহান্নামি।
  • আল্লাহর বিশেষ দাসরা
    • অন্য একটি মত হলো, তারা এমন লোক যারা দুনিয়াতে নেক আমল করেছিল, কিন্তু কিছু কারণে জান্নাতে ঢুকতে বিলম্ব হচ্ছে।
    • তবে তারা শেষ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করবে। ]
  • আর যখন আ‘রাফের লোকেরা জাহান্নামীদের দিকের দিকে তাকাবে, তখন তারা আল্লাহর কাছে বলবে: “হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে জালেম সম্প্রদায়ের সঙ্গে রাখবেন না। [ আ‘রাফে যারা থাকবে, তারা জান্নাতিদেরও দেখবে, জাহান্নামীদেরও দেখবে। যখন তারা জাহান্নামের শাস্তি ও ভয়াবহ অবস্থা দেখবে, তখন ভয়ে কেঁপে উঠবে। তখন তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে যেন তাদেরকে ওই জালেম ও অবিশ্বাসীদের দলে না রাখা হয়। ]
  • আ‘রাফের লোকেরা জান্নাত-জাহান্নামের মাঝ থেকে উভয় পক্ষের মানুষকে চিনবে তাদের চিহ্ন দ্বারা। তারা জাহান্নামীদের মধ্যে কিছু লোককে ডেকে বলবে: তোমাদের দলবদ্ধতা, গর্ব বা অহংকার, আর যা কিছু তোমরা অর্জন করেছিলে—সেগুলো আজ তোমাদের কোনো কাজে আসছে না। [ আ‘রাফবাসীরা যখন জাহান্নামের লোকদের চিনবে, তখন তাদেরকে উদ্দেশ করে বলবে—দুনিয়াতে তোমরা যেই দলে গর্ব করেছিলে, সম্পদ ও শক্তির উপর ভরসা করেছিলে, আজ সেগুলো একটুও উপকারে আসছে না। এ কথার মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে যে দুনিয়ার অহংকার, সম্পদ বা ক্ষমতা কিয়ামতের দিনে কাউকে রক্ষা করতে পারবে না। ]
  • [ আ‘রাফবাসীরা জান্নাতিদের উদ্দেশে বলবে:] এরাই কি তারা (অর্থাৎ জান্নাতবাসীরা) , যাদের সম্বন্ধে তোমরা (জাহান্নামীরা) শপথ করে বলতে যে, আল্লাহ তাদের প্রতি কোন দয়া দেখাবেন না। (এদেরকেই বলা হবে,) তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর, তোমাদের কোন ভয় নেই এবং তোমরা চিন্তিতও হবে না।

[ এ আয়াতে আসলে তাদের কথা বোঝানো হয়েছে, যারা দুনিয়াতে ছিল নিঃস্ব, দরিদ্র ও সমাজে তুচ্ছ গণ্য মানুষ। ধনীরা ও অহংকারীরা তাদের নিয়ে উপহাস করত। তারা বলত—“যদি এরা সত্যিই আল্লাহর প্রিয় হতো, তবে দুনিয়াতে এদের এমন করুণ অবস্থা কেন হতো?” এমনকি তারা ধৃষ্টতা করে আরও বলত—“কিয়ামতের দিনও আল্লাহর রহমত কেবল আমাদের জন্যই হবে, এদের জন্য নয়।”

তাফসীর ইবনে কাসীরের বর্ণনায় আছে—কেউ কেউ বলেছেন, এই কথাগুলো আ‘রাফবাসীরাই বলবে। আবার অন্যরা বলেছেন, যখন আ‘রাফবাসীরা জাহান্নামীদের উদ্দেশে বলবে—“তোমাদের দলবল আর অহংকার কোনো কাজে এল না”—তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে জান্নাতিদের দিকে ইঙ্গিত করে ঘোষণা করা হবে—“এই সেই মানুষরা, যাদের সম্পর্কে তোমরা কসম খেয়ে বলেছিলে যে, এদের প্রতি আল্লাহর রহমত হবে না। অথচ আজ তারাই জান্নাতে প্রবেশ করেছে।” ]

  • আর জাহান্নামীরা জান্নাতবাসীদেরকে সম্বোধন করে বলবে, আমাদের উপর ঢেলে দাও কিছু পানি, অথবা তা থেকে যা আল্লাহ্‌ জীবিকারূপে তোমাদেরকে দিয়েছেন। তারা বলবে আল্লাহ্‌ তো এ দুটি হারাম করেছেন কাফেরদের জন্য। [ জাহান্নামের তীব্র আগুনে দগ্ধ হয়ে জাহান্নামিরা তৃষ্ণায় কাতর হতে থাকবে। তখন তারা জান্নাতিদের ডাক দিয়ে পানির বা অন্য কোনো রিজিকের আবেদন জানাবে। কিন্তু জান্নাতিরা জানিয়ে দেবে—আল্লাহর হুকুমেই এসব নিয়ামত কাফেরদের জন্য হারাম করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, তারা দুনিয়াতে যেমন আল্লাহর সত্য অস্বীকার করেছিল, আখিরাতে তেমনি জান্নাত ও জান্নাতের নিয়ামত থেকেও বঞ্চিত হবে।]

আয়াত ৭ : ৫১ - ৫৫

  • তারা ছিল সেইসব লোক, যারা তাদের ধর্মকে খেলা ও আমোদ-ফুর্তির বস্তু বানিয়ে নিয়েছিল, আর দুনিয়ার জীবন তাদেরকে প্রতারিত করেছিল। তাই আজ আমি তাদেরকে ভুলে যাবো, যেমন তারা এই দিনের সাক্ষাৎকে ভুলে গিয়েছিল এবং আমার আয়াতগুলোকে অস্বীকার করেছিল। [ এ আয়াতে আল্লাহ তাদের কথা বলেছেন যারা দুনিয়াতে ধর্মকে তুচ্ছ করেছিল, এটিকে খেলা-তামাশা ভেবেছিল, আর দুনিয়ার ভোগ-বিলাসে ডুবে গিয়েছিল। তারা আখিরাতকে গুরুত্ব দেয়নি এবং আল্লাহর আয়াত অস্বীকার করেছিল। তাই কিয়ামতের দিন আল্লাহও তাদেরকে পরিত্যাগ করবেন, তাদেরকে সাহায্য করবেন না। যেমন তারা দুনিয়ায় আল্লাহর সাক্ষাতের দিনকে ভুলে গিয়েছিল, তেমনি আজ তারা নিজেও বিস্মৃত ও বঞ্চিত থাকবে।]
  • আর অবশ্যই আমরা তাদের নিকট নিয়ে এসেছি এমন এক কিতাব, যা আমরা জ্ঞানের ভিত্তিতে বিশদ ব্যাখ্যা করেছি। আর যা মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য হিদায়াত ও রহমতস্বরূপ। [ আল্লাহ তাআলা কাফের ও মুশরিকদের কোনো ওজর আপত্তি তোলার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি তাদের কাছে রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং রাসূলের মাধ্যমে কিতাব পৌঁছে দিয়েছেন, যা সবকিছু স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। অন্যান্য আয়াতেও আল্লাহ এই বিস্তারিত নির্দেশনার কথা উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ, যারা বিশ্বাসী, তারা এই কিতাব থেকে সহজেই হেদায়েত ও আল্লাহর দয়া লাভ করবে।]
  • তারা কি শুধু সে পরিণামের (সংবাদ-সত্যতা বা কিয়ামতের) অপেক্ষা করে? যেদিন সে পরিণাম বাস্তবায়িত হবে, সেদিন যারা আগে সেটার কথা ভুলে গিয়েছিল তারা বলবে, আমাদের রবের রাসূলগণ তো সত্যবাণী এনেছিলেন, আমাদের কি এমন কোন সুপারিশকারী আছে যে আমাদের জন্য সুপারিশ করবে অথবা আমাদেরকে কি আবার ফেরত পাঠানো হবে- যেন আমরা আগে যা করতাম তা থেকে ভিন্ন কিছু করতে পারি? অবশ্যই তারা নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং তারা যে মিথ্যা রটনা করত, তা তাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। [ আয়াতে বলা হয়েছে, কাফেররা কিয়ামতের দিন আল্লাহর আদেশ ও সত্যের পরিণাম দেখবে। তখন তারা বলবে—“আমাদের রবের রসূলরা তো সত্যবাণী এনেছিলেন। এখন কি কেউ আমাদের পক্ষ নিয়ে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে? আমাদের কি আবার পৃথিবীতে পাঠানো হবে, যেন আমরা ভিন্ন কিছু করি?” এখানে বোঝানো হয়েছে যে, তারা দুনিয়াতে আল্লাহর সত্যকে অস্বীকার করেছিল, মিথ্যা প্রচার করেছিল এবং নিজেদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে। কিয়ামতের দিন তারা নিজেই স্বীকার করবে যে তাদের ক্ষতি হয়েছে এবং তাদের উদ্ভাবিত মিথ্যা বা ভুল বিশ্বাসও তাদের থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে । সংক্ষেপে, আয়াতটি আমাদের শেখায়—যারা আল্লাহর সত্য অস্বীকার করে এবং মিথ্যা রচনা করে, তারা নিজেরাই শেষ পর্যন্ত নিজের ক্ষতি করবে। তাদের জন্য কোনো মধ্যস্থতা বা দ্বিতীয় সুযোগ থাকবে না। অর্থাৎ, যারা আল্লাহর সত্যকে অস্বীকার করেছে, তাদের কোনো মধ্যস্থতা বা সুযোগ থাকবে না, এবং তাদের ভুলকর্মের ফল ভোগ করতে হবে।]
  • নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেন, অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন। তিনিই দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন; ওদের একে অন্যকে দ্রুতগতিতে অনুসরণ করে। আর (সৃষ্টি করেছেন) সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্ররাজিকে, যা তাঁরই আজ্ঞাধীন। জেনে রাখ, সৃষ্টি করা এবং নির্দেশদান তাঁরই কাজ। তিনি মহিমময় বিশ্ব প্রতিপালক।
  • [ আয়াতে বলা হয়েছে,
    • আল্লাহ ছয় দিনে আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এখানে অনেক তাফসীরবিদ মনে করেছেন যে, “ছয় দিন” বলতে জাগতিক অর্থে ৬ দিনই বোঝানো হয়েছে। কিন্তু সঠিকভাবে বোঝা প্রয়োজন—বিশ্ব সৃষ্টির সময় সূর্য, চাঁদ বা অন্যান্য নক্ষত্র ছিল না। সেই পরিস্থিতিতে আমাদের দৈনন্দিন দিনের হিসাব (সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দিন, এবং সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত রাত) প্রযোজ্য নয়।
    • আল্লাহর কাছে “ছয় দিন” বলতে অন্য কোনো এক ধাপে বা পর্যায়ে সৃষ্টি-কার্যের হিসাব বোঝানো হতে পারে, যা আমাদের জগতের দিনের সংজ্ঞার সাথে মেলেনা। যেমন জান্নাতের দিন-রাত্রি আমাদের পৃথিবীর দিনের সঙ্গে তুলনীয় হবে না। মূল শিক্ষা হলো—আল্লাহ বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন নির্দিষ্ট ধাপে এবং তিনি সমস্ত সময় ও সৃষ্টির হিসাবের কর্তৃত্বশালী।
    • আল্লাহ তা'আলা আরশের উপর উঠেছেন এটা সহীহ আকীদা। কিন্তু তিনি কিভাবে উঠেছেন, কুরআন-সুন্নায় এ ব্যাপারে কোন বক্তব্য নাই বিধায় তা আমরা জানি না।
    • আল্লাহ তাআলা রাত্রির মাধ্যমে দিনকে ঢেকে দেন, অর্থাৎ রাত দ্রুত দিনকে ছুঁয়ে ফেলে। এর উদ্দেশ্য হলো সমগ্র বিশ্বকে আলো থেকে অন্ধকারে এবং আবার অন্ধকার থেকে আলোতে পরিবর্তিত করা। এই বিরাট পরিবর্তন আল্লাহর কুদরতে অত্যন্ত দ্রুত ও সহজভাবে ঘটে।
    • আল্লাহ সূর্য, চাঁদ এবং নক্ষত্রগুলোকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, তারা পুরোপুরি তাঁর আদেশ অনুযায়ী চলে। অর্থাৎ, তাদের চলাচল, গতি এবং অবস্থান একদম নির্ভুল এবং নির্দিষ্ট নিয়মে চলে। কেউ বা কিছু এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাতে পারে না। এটি আমাদের জন্য চিন্তার খোরাক—এখানেই আমরা বুঝি যে, পৃথিবী ও ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে এবং তাঁর অনুগ্রহ ও নির্দেশ অনুযায়ীই চলছে।
      • এই নিয়মিত চলাচল এবং ধারাবাহিকতা এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, কোনো ধরনের ত্রুটি, বিলম্ব বা পার্থক্য আসাও অসম্ভব। সূর্যের উত্তাপ, চাঁদের আলোক, বা রাত-দিনের পরিবর্তন—সবই আল্লাহর নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটে। তবে এই ধারাবাহিক নিয়ম স্থায়ী নয়। যখন সর্বশক্তিমান আল্লাহ ইচ্ছা করবেন, নির্দিষ্ট সময়ে এই সমস্ত ব্যবস্থা এক মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাবে। সূর্য, চাঁদ, নক্ষত্র, রাত-দিন, আকাশ-বিশ্ব—সবই আল্লাহর ইচ্ছায় তছনছ হয়ে যাবে—এটাই কিয়ামতের সূচনা। ]
  • তোমরা তোমাদের রবকে বিনীতভাবে ও গোপনে ডাক । নিশ্চয়ই তিনি সীমালংঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।

[ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, আমাদের উচিত আল্লাহকে বিনীতভাবে, নম্রভাবে এবং গোপনে ডাকা । এতে বোঝানো হচ্ছে যে, শুধু বাহ্যিক প্রদর্শনের জন্য নয়, অন্তরের ভীতি, ভক্তি এবং প্রার্থনা সহ আল্লাহর কাছে ডাকা সবচেয়ে কার্যকর। তবে কিছু বিশেষ সময় ও পরিস্থিতিতে সরব যিকরই কাম্য ও উত্তম। উদাহরণস্বরূপ—আজান ও একামত উচ্চস্বরে বলা, সালাতে উচ্চস্বরে কুরআন তিলাওয়াত, সালাতের তাকবীর, হজে পুরুষদের জন্য “লাব্বাইকা” উচ্চস্বরে বলা। আলেমরা এই বিষয়ে একমত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব বিশেষ পরিস্থিতি ও স্থানে সরব যিকরের শিক্ষা দিয়েছেন, সেখানে তা অবশ্যই করা উচিত। এছাড়া অন্যান্য অবস্থা ও স্থানে নীরব যিকরই উত্তম ও অধিক উপকারী।

এছাড়াও আয়াতটি সতর্ক করছে যে, যারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে অত্যাচার বা অন্যায় চালায়, আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন না। ]


আয়াত ৭ : ৫৬ - ৬০

  • আর যমীনে শান্তি স্থাপনের পর তোমরা সেখানে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না আর আল্লাহকে ভয় ও আশার সাথে ডাকো । নিশ্চয় আল্লাহর অনুগ্রহ সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী । [ আল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, পৃথিবীতে যখন তিনি শান্তি, স্থিতি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছেন, তখন যেন আমরা অন্যায়, পাপ ও জুলুমের মাধ্যমে সেটাকে নষ্ট না করি। আমাদের উচিত তাঁর কাছে দোয়া করা বিনয় ও ভয়ের সাথে, আবার একই সাথে তাঁর রহমতের আশায় ভরসা রেখে। কারণ, আল্লাহর দয়া তাঁর মুমিন সৎকর্মশীল বান্দাদের খুব কাছেই থাকে—তারা যদি আন্তরিকভাবে সৎকাজ করে ও তাঁর পথে চলে, তবে নিশ্চয়ই তাঁর রহমত ও সাহায্য তাদের ওপর নাজিল হয়। ]

  • তিনিই সেই আল্লাহ, যিনি তাঁর রহমতের পূর্বাভাস হিসেবে বাতাস পাঠান। যখন বাতাস ভারী মেঘকে উঠিয়ে আনে, তখন আমরা সেটাকে মৃতপ্রায় ভূমির দিকে নিয়ে যাই। অতঃপর সেখান থেকে পানি বর্ষণ করি এবং এর মাধ্যমে নানারকম ফল-ফসল উৎপন্ন করি। এভাবেই আমরা মৃতদের জীবিত করি, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। [ আল্লাহ্‌ মানুষকে বোঝাচ্ছেন, বৃষ্টি কেবল একটি প্রাকৃতিক ব্যাপার নয়, বরং এটি তাঁর রহমতের নিদর্শন। প্রথমে তিনি বাতাস পাঠান, যা মেঘ জমায় এবং ভারী করে তোলে। তারপর সেই মেঘ শুকনো ও অনুর্বর জমির উপর নিয়ে আসা হয়। আল্লাহ্‌ সেখানে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং সেই পানির মাধ্যমে শুকনো মাটি থেকে ফসল ও ফল-ফলাদি বের হয়ে আসে। যেমন শুকনো জমি আবার জীবিত হয়, ঠিক তেমনি কিয়ামতের দিন আল্লাহ্‌ মৃতদের পুনরায় জীবিত করবেন। এটি মানুষের জন্য আল্লাহর ক্ষমতা ও কুদরতের একটি স্পষ্ট শিক্ষা। ]

  • উর্বর জমি তার প্রতিপালকের অনুমতিতে প্রচুর ফসল উৎপন্ন করে, আর অনুর্বর জমি থেকে সামান্যই ফল জন্মে। এভাবেই আমি কৃতজ্ঞ সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনসমূহ বিভিন্নভাবে বর্ণনা করি। [ এই আয়াতে আল্লাহ্ জমিনের দৃষ্টান্ত দিয়ে মানুষের অন্তরকে বোঝাচ্ছেন। যেমন উর্বর জমি পানি পেয়ে প্রচুর ফল-ফলাদি উৎপাদন করে, তেমনি ভালো ও নরম হৃদয় আল্লাহর হিদায়াত গ্রহণ করে এবং কল্যাণ ছড়িয়ে দেয়। আর অনুর্বর জমি যেমন বৃষ্টি পেলেও সামান্য ফল দেয়, তেমনি জেদী ও কঠিন হৃদয়ও আল্লাহর নির্দেশ শুনে উপকৃত হয় না। এভাবে আল্লাহ মানুষকে শিক্ষা দেন, যেন তারা কৃতজ্ঞ হয় এবং তাদের অন্তরকে সত্য গ্রহণের জন্য প্রস্তুত রাখে। ]

  • অবশ্যই আমরা নূহকে পাঠিয়েছিলাম তার সম্প্রদায়ের কাছে। অতঃপর তিনি বলেছিলেন, হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ্‌র ইবাদত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। নিশ্চয় আমি তোমাদের উপর মহাদিনের শাস্তির আশংকা করছি । [ আল্লাহ এখানে নূহ (আঃ) এর কাহিনী স্মরণ করাচ্ছেন। তিনি নূহকে তাঁর সম্প্রদায়ের কাছে পাঠিয়েছিলেন, যাতে তারা একমাত্র আল্লাহর উপাসনা করে। কিন্তু মানুষ তাকে অবজ্ঞা ও উপহাস করেছে। ফলে আল্লাহ নূহকে এবং যাদের সঙ্গে তিনি নৌকায় ছিলেন, নিরাপদ রেখেছেন। আর যারা তাঁর আয়াত অস্বীকার ও মিথ্যাচার করেছে, তাদেরকে কঠোর শাস্তি দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে । এই ঘটনা মানুষের জন্য শিক্ষা, যেন তারা সতর্ক হয় এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য বজায় রাখে। ]

  • তার সম্প্রদায়ের প্রধানরা বলেছিল, আমরা তো তোমাকে স্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে দেখছি । [ নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের অভিজাত ও প্রভাবশালী লোকেরা বলল, “আমরা তোমাকে স্পষ্ট পথভ্রষ্ট অবস্থায় দেখছি।” অর্থাৎ তারা নূহকে মিথ্যাবাদী ও বিভ্রান্ত মনে করেছিল এবং আল্লাহর পথে আহ্বানকে অগ্রাহ্য করল। ]


আয়াত ৭ : ৬১ - ৬৫

  • তিনি বলেছিলেন, হে আমার সম্প্রদায়! আমার মধ্যে কোন ভ্রষ্টতা নেই, বরং আমি তো সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে রাসূল । [ নূহ (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন, যে তিনি নিজে কখনও পথভ্রষ্ট নন। তিনি আল্লাহর সত্যিকারের দূত এবং সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালকের প্রতিনিধি। তাঁর বার্তা আল্লাহর নির্দেশে এসেছে, তাই এটি সত্য এবং নির্ভুল। ]
  • [ নূহ (আঃ) বললেন ], আমি তোমাদের কাছে আমার প্রতিপালকের বার্তা পৌঁছে দিচ্ছি এবং তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি। আর তোমরা যা জান না, আমি তা আল্লাহর নিকট হতে জানি । [ নূহ (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে বলেন যে, তিনি শুধু আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন। তিনি সতর্ক করছেন, উপদেশ দিচ্ছেন এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন জ্ঞান রাখছেন যা তারা জানে না। ]
  • তোমরা কি বিস্মিত যে, তোমাদের মধ্য থেকেই একজন মানুষের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে উপদেশ এসেছে—যাতে তিনি তোমাদের সতর্ক করেন, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর এবং যাতে তোমরা রহমতপ্রাপ্ত হও?

[ নূহ (আঃ)-এর কাহিনীর পটভূমি - নূহ (আঃ) এবং আদম (আঃ)-এর মধ্যে ব্যবধান হল দশ শতাব্দী অথবা দশ পুরুষ। নূহ (আঃ)-এর কিছু পূর্ব থেকে সমস্ত মানুষ তাওহীদের উপরেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। অতঃপর সর্বপ্রথম তাওহীদ থেকে বিচ্যুতি এইভাবে ঘটে যে, যখন এই জাতির নেক লোকেরা মারা যান, তখন তাঁদের ভক্তরা তাঁদের বসার জায়গাগুলোকে উপাসনালয় বানিয়ে নেয় এবং তাঁদের চিত্রও সেখানে ঝুলিয়ে দেয়। এ থেকে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, এইভাবে তারা তাঁদেরকে স্মরণ করে তারাও তাঁদের মত আল্লাহর যিকর ও ইবাদত করবে এবং সেই যিকর ও ইবাদতে তাঁদের অনুকরণ করবে। অতঃপর যখন কিছু কাল অতিবাহিত হল, তখন তারা এই চিত্রগুলোর মূর্তি নির্মাণ করল। তারপর কিছু কাল কেটে গেলে সে মূর্তিগুলো দেবতার আকার ধারণ করল এবং তাদের পূজাপাঠ আরম্ভ হয়ে গেল। এইভাবে নূহ (আঃ)-এর জাতির অদ্দ্, সুওয়া’, ইয়াগূস, ইয়াউক ও নাসর নামের পাঁচজন নেক লোক উপাস্য বনে গেলেন। এই অবস্থায় মহান আল্লাহ নূহ (আঃ)-কে তাদের মাঝে নবী বানিয়ে প্রেরণ করলেন। তিনি সাড়ে নয় শত বছর পর্যন্ত তাদেরকে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিলেন। কিন্তু অল্প সংখ্যক কিছু লোক ছাড়া তাঁর দাওয়াতের প্রভাব কারো উপর পড়ল না। পরিশেষে ঈমানদারদের ছাড়া সকলকেই ডুবিয়ে ধ্বংস করা হল। এই আয়াতে বলা হচ্ছে যে, নূহ (আঃ)-এর জাতি এ ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল যে, তাদেরই মধ্য থেকে একজন নবী হয়ে এসেছে, যে তাদেরকে আল্লাহর আযাবের ভয় দেখায়? অর্থাৎ, তাদের ধারণা ছিল, মানুষ নবী হওয়ার উপযুক্ত নয়। - তাফসীরে আহসানুল বায়ান ]

  • কিন্তু তারা (নূহ আঃ-কে) মিথ্যা বলল। ফলে আমরা নূহকে এবং তার সঙ্গে নৌকায় থাকা লোকদের উদ্ধার করলাম। আর যারা আমাদের আয়াত অস্বীকার করেছিল, তাদেরকে আমরা ডুবিয়ে ধ্বংস করলাম। নিশ্চয়ই তারা ছিল অন্ধ এক সম্প্রদায়। [ নূহ (আঃ)-এর জাতির অধিকাংশ লোক তাঁর দাওয়াত অস্বীকার করেছিল এবং সত্যকে মানতে অস্বীকার করেছিল। তখন আল্লাহ তাঁর সত্যতা প্রমাণ করলেন—তাঁকে এবং অল্পসংখ্যক মুমিন সঙ্গীদের নৌকায় নিরাপদে রক্ষা করলেন। আর যারা অবিশ্বাস করেছিল, তারা সবাই মহাপ্লাবনে ধ্বংস হয়ে গেল। এখানে “অন্ধ সম্প্রদায়” বলতে বোঝানো হয়েছে, তারা সত্যকে দেখতে চায়নি; জেদ, অজ্ঞতা ও অহংকারের কারণে তারা নিজেদের ধ্বংস ডেকে এনেছিল। ]

  • আর ‘আদ জাতির প্রতি আমি তাদের ভাই হূদকে পাঠালাম। তিনি বললেন,হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তোমাদের জন্য তিনি ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই। তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করবে না ?

[ আদ জাতির কাছে আল্লাহ নবী হিসেবে হূদ (আঃ)-কে পাঠালেন। তিনি তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাকলেন এবং মূর্তিপূজা থেকে বিরত থাকতে বললেন। কিন্তু তাঁর জাতি অহংকারে অন্ধ হয়ে আল্লাহর একত্ব মানতে চাইলো না। তাই তিনি তাদেরকে সতর্ক করলেন—আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্যিকার উপাস্য নেই, আর আল্লাহকে ভয় না করলে তোমরা ধ্বংসের মুখে পড়বে।

আদ জাতির সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও ধ্বংসের কারণ: আদ জাতি ছিল আরব উপদ্বীপের প্রাচীন এক সমৃদ্ধ জাতি, যাদের বসবাস ছিল "আহকাফ" অঞ্চলে (আজকের ইয়েমেন ও ওমানের মরুভূমি এলাকায়)। তারা ছিল দেহে বলিষ্ঠ, লম্বা-চওড়া, শক্তিশালী ও উন্নত স্থাপত্য নির্মাণে পারদর্শী। তারা উঁচু প্রাসাদ ও সুউচ্চ অট্টালিকা তৈরি করত এবং নিজেদের শক্তি নিয়ে অহংকার করত।

কিন্তু তারা আল্লাহকে ভুলে গিয়ে মূর্তি ও মিথ্যা উপাস্যদের পূজা শুরু করে। হূদ (আঃ) তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাকলেও তারা তা অস্বীকার করে এবং তাঁকে মিথ্যাবাদী বলে উপহাস করে। অবশেষে তাদের জেদ, অহংকার ও কুফরির কারণে আল্লাহ তাদের উপর প্রবল ঝোড়ো বাতাস (প্রচণ্ড ঝড়/হাওয়াস-সরসার - প্রচণ্ড শব্দময়, শীতল, ঝঞ্ঝাবহুল ঝড় ) পাঠান, যা সাত রাত ও আট দিন অবিরাম বয়ে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে এই শক্তিশালী জাতি চিরতরে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ]


আয়াত ৭ : ৬৬ - ৭০

  • তার সম্প্রদায়ের প্রধানরা, যারা কুফরী করেছিল, তারা বলেছিল, আমরা তো তোমাকে নির্বুদ্ধিতায় নিপতিত দেখছি। আর আমরা তো তোমাকে মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত মনে করি।
  • তিনি বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! আমার মধ্যে কোন নির্বুদ্ধিতা নেই, বরং আমি সৃষ্টিকুলের রবের পক্ষ থেকে একজন রাসূল । [ হুদ (আঃ) তাদেরকে বোঝালেন যে, তিনি কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থে বা মিথ্যা ধারনা নিয়ে কথা বলছেন না। তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নবী, যিনি তাদেরকে সঠিক পথ দেখাতে এসেছেন । ]
  • আমি আমার রবের বার্তা তোমাদের নিকট পৌঁছে দিচ্ছি, আর আমি তোমাদের একজন বিশ্বস্ত হিতাকাংখী । [ হুদ (আঃ) বললেন — তিনি শুধু নবী হিসেবে আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন। এছাড়া, তিনি তাদের জন্য সত্যিকার উপদেশদাতা, যিনি তাদের কল্যাণের কথা চিন্তা করছেন। তিনি কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ বা স্বেচ্ছাচারী উদ্দেশ্যে কথা বলছেন না। ]
  • তোমরা কি বিস্মিত হচ্ছ যে, তোমাদের কাছে তোমাদের একজনের মাধ্যমে তোমাদের রবের কাছ থেকে তোমাদেরকে সতর্ক করার জন্য উপদেশ এসেছে ? এবং স্মরণ কর যে, আল্লাহ তোমাদেরকে নূহের সম্প্রদায়ের পরে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং সৃষ্টিতে তোমাদেরকে অন্যদের অপেক্ষা শক্তিতে অধিকতর বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছেন। কাজেই তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, হয়তো তোমরা সফলকাম হবে। [হুদ (আঃ) তাঁর সম্প্রদায়ের মানুষদের বললেন—বিস্ময়ের কিছু নেই যে আল্লাহ তোমাদের জন্য একটি বার্তা পাঠিয়েছেন। এটি একজন মানুষের মাধ্যমে এসেছে, যিনি তোমাদের সতর্ক করবেন এবং সঠিক পথ প্রদর্শন করবেন। অতীতে আল্লাহ নূহ (আঃ)-এর পরে তোমাদেরকে পৃথিবীর দায়িত্বশীল উত্তরাধিকারী বানিয়েছেন এবং সৃষ্টিতে বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছেন। তাই তোমাদের উচিত আল্লাহর নিয়ামত ও অনুকম্পা মনে রাখা এবং তা মেনে চলা, যাতে তোমরা সঠিক পথে চলতে পারো এবং সত্যিকারের কল্যাণ ও সাফল্য অর্জন করতে পারো। ]
  • তারা বলল, তুমি কি আমাদের নিকট এ উদ্দেশ্যে এসেছে যে, আমরা যেন শুধু আল্লাহর উপাসনা করি এবং আমাদের পূর্বপুরুষগণ যার উপাসনা করত তা বর্জন করি? সুতরাং তুমি সত্যবাদী হলে আমাদেরকে যে (আযাবের) ভয় দেখাচ্ছ তা আনয়ন কর। [হুদ (আঃ)-এর সম্প্রদায় নবীর উদ্দেশ্যকে ভুলভাবে বোঝে। তারা বলল—“তুমি কি আমাদের কাছে এ উদ্দেশ্যে এসেছো যে আমরা শুধু আল্লাহর উপাসনা করি এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের উপাসনা পরিত্যাগ করি? যদি তুমি সত্যবাদী হও, তবে আমাদেরকে যে ভয় দেখাচ্ছ, সেটি সত্যিকারের শাস্তি হিসেবে প্রমাণ কর। ]

আয়াত ৭ : ৭১ - ৭৫

  • হূদ বলল, ‘তোমাদের প্রতিপালকের শাস্তি ও ক্রোধ তো তোমাদের উপর নির্ধারিত হয়েই আছে, তবে কি তোমরা আমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হতে চাও এমন কতকগুলি নাম সম্বন্ধে, যার নামকরণ তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষেরা করেছে এবং সে সম্বন্ধে আল্লাহ কোন সনদ পাঠাননি? সুতরাং তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমিও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষা করছি।’

[ এই আয়াতে হুদ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের রাখা নামগুলো বোঝানো হয়েছে, যেগুলো তারা নিজেদের উপাস্য বা মূর্তিদের জন্য রেখেছিল। যেমন নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের পাঁচটি মূর্তির নাম আল্লাহ কুরআনে উল্লেখ করেছেন—স্বাদা, স্বুমূদ, হাবা ইত্যাদি। অনুরূপভাবে আরবের মুশরিকদের মূর্তির নাম ছিল লাত, মানাত, উয্যা, হুবাল ইত্যাদি।

এ ধরনের নাম বা উপাধি মূলত নিছক নাম বা চিহ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়। এগুলোর পিছনে কোনো বাস্তব সত্তা বা স্বতন্ত্র ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ, তোমরা যে আল্লাহকে সর্বশ্রেষ্ঠ রব বলে বিশ্বাস করো, তিনি কখনো এই মূর্তিদের বা দেবদেবীর কাছে তার ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের কোনো অংশ স্থানান্তর করেছেন না। আল্লাহ কোথাও বলেননি যে, “আমি অমুক বা অমুকের কাছে আমার ইলাহী শক্তির এতটা অংশ দিয়েছি।” বরং মানুষ নিজেদের কল্পনা ও ধারণা অনুযায়ী এসব মূর্তিকে দেবতা বা উপাস্য বানিয়েছে অথচ আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং একমাত্র কর্তৃত্বশালী। ]

  • তারপর আমরা তাকে ও তার সাথীদেরকে আমাদের অনুগ্রহে উদ্ধার করেছিলাম; আর আমাদের আয়াতসমূহে যারা মিথ্যারোপ করেছিল এবং যারা মুমিন ছিল না তাদেরকে নির্মুল করেছিলাম। [ এই আয়াতের প্রেক্ষাপট অনুযায়ী হুদ (আঃ)-এর সম্প্রদায়, অর্থাৎ আ’দ জাতি, তাদের অবিশ্বাস ও অহংকারের কারণে আল্লাহর প্রবল শাস্তির মুখোমুখি হয়েছিল। আল্লাহ তাদের ওপর এমন এক প্রবল ঝঞ্ছাবায়ু নাজিল করেছিলেন, যা সাত রাত এবং আট দিন অব্যাহত থাকে। এই ঝঞ্ছাবায়ু সবকিছু ধূলিসাৎ করে দেয়—গাছ, গৃহ, প্রাণী—কিছুই বাঁচতে পারেনি। আ’দ জাতির লোকেরা নিজেদের শক্তি, দেহ ও সম্পদের উপর অহংকার করত; কিন্তু শাস্তির ফলে তাদের লাশগুলো এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে, যেন কাটা খেজুর গাছের কান্ড মাটিতে ছিটকে পড়েছে। এটি মানুষের জন্য একটি স্পষ্ট শিক্ষা যে, অহংকার ও অবিশ্বাস কখনো আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পায় না, এবং প্রকৃত শক্তি ও ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। ]

  • আর সামূদ জাতির নিকট তাদের ভাই সালেহকে পাঠিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। অবশ্যই তোমাদের নিকট তোমাদের রবের পক্ষ হতে স্পষ্ট নিদর্শন এসেছে। এটি আল্লাহর উষ্ট্রী, তোমাদের জন্য নিদর্শনস্বরূপ। সুতরাং তোমরা তাকে আল্লাহর যমীনে চরে খেতে দাও এবং তাকে কোন কষ্ট দিও না, দিলে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তোমাদেরকে পেয়ে বসবে।

[ সামূদ জাতি: পরিচয় ও ধ্বংসের কারণ

সামূদ আরবের প্রাচীন জাতিগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় জাতি। আদ জাতির পরে এরা সবচেয়ে বেশি পরিচিতি ও খ্যাতি অর্জন করে। তারা হিজাযের উত্তর-পশ্চিম ও সিরিয়ার মাঝবর্তী অঞ্চলে ‘আল-হিজর’ নামে পরিচিত এলাকায় বসবাস করত। আজকের সাউদী আরবের মদীনা ও তাবুকের মধ্যে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দূরে মাদায়েনে সালেহ নামে একটি কেন্দ্রীয় স্থান ছিল। সামূদগোত্র পারদর্শী ছিল পাহাড় খোদাই ও বিশালায়তন ইমারত নির্মাণে, যা আজও বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়।

আল্লাহ তাদেরকে নবী সালেহ (আঃ) প্রেরণ করেছিলেন। সালেহ (আঃ) তাদেরকে একত্ববাদের দাওয়াত দিতেন। কিন্তু তারা নবীর বার্তা বিশ্বাস না করে একটি বিশেষ দাবী তোলে—একটি পাথরের ভেতর থেকে দশ মাসের গর্ভবতী, স্বাস্থ্যবান উষ্ট্রী বের করে দেখানোর অনুরোধ। সালেহ (আঃ) প্রথমে তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নেন যে, এই নিদর্শন দেখানোর পরে তারা ঈমান আনবে। তাদের অঙ্গীকারের পর আল্লাহর নির্দেশে পাথরের ভেতর থেকে উষ্ট্রী বের হয়।

উষ্ট্রীটি আল্লাহর দিক থেকে নিদর্শন ও মু’জিযা হিসেবে প্রেরিত। এটি সামূদদের জন্য পরীক্ষা ও দাওয়াতের মাধ্যম। সালেহ (আঃ) তাদেরকে সতর্ক করেন যে, উষ্ট্রীকে কষ্ট দিলে বা হত্যা করলে আযাব আসবে। সামূদগোত্র এই নিদর্শনকে হত্যা করে, যা তাদের অবিশ্বাস ও বিদ্রোহের প্রকাশ।

এরপর আল্লাহ তাদের ওপর প্রচণ্ড আযাব প্রেরণ করেন—এক বিকট চিৎকার ও প্রলয়কর ঝঞ্ছাবায়ু (صَيْحَةٌ) এবং কম্পন (رَجْفَةٌ) এ আঘাত করে। তাদের লাশগুলো উপুড় হয়ে পড়ে। তাদের ধ্বংসের মূল কারণ ছিল অহংকার, নবীর বার্তা অগ্রাহ্য করা, আল্লাহর নিদর্শন অমান্য করা এবং মূর্তিপূজা। - তাফসীরে জাকারিয়া ]

  • আর স্মরণ কর, আ’দ জাতির পরে তিনি তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং তিনি তোমাদেরকে পৃথিবীতে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, তোমরা সমতলভূমিতে প্রাসাদ এবং পাহাড় কেটে বাসগৃহ নির্মাণ করছ। সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় ঘটিও না।

[ আল্লাহ সামূদ জাতিকে আদ জাতির পর উত্তরসূরি করেছিলেন। তিনি তাদেরকে শক্তি, উন্নতি এবং স্থায়ী আবাসের সুযোগ দিয়েছিলেন। তারা সমতল ভূমিতে প্রাসাদ নির্মাণ করত এবং পাহাড় কেটে ঘর তৈরি করত। অর্থাৎ তারা স্থাপত্য ও প্রযুক্তিতে উন্নত ছিল। কিন্তু এত নেয়ামত পাওয়ার পরও তারা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হলো না, বরং অন্যায় ও অবাধ্যতায় লিপ্ত হলো। তাই আল্লাহ তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিলেন—তোমরা তাঁর নেয়ামত মনে রেখো, কৃতজ্ঞ হও, আর পৃথিবীতে ফিতনা ও অশান্তি সৃষ্টি করো না।
এই আয়াত থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্পষ্ট হয়—সব নবীদের মূল দাওয়াত একই ছিল। তা হলো, একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা, তাঁর নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, এবং অন্যায়, ফিতনা ও অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা। যারা এই দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছে, তারা দুনিয়া ও আখেরাত—দুটিতেই শাস্তির মুখোমুখি হয়েছে। ]

  • তাঁর সম্প্রদায়ের উদ্ধত নেতারা দুর্বল মুমিনদের উদ্দেশে বলল, ‘তোমরা কি জানো যে, সালেহ তার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রেরিত?’ তারা বলল, নিশ্চয় তিনি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন, আমরা তার উপর ঈমানদার। [ সামূদ জাতির অহংকারী নেতারা মুমিনদের উপহাস করে প্রশ্ন করল—তোমরা কি সত্যিই মনে কর, সালেহ (আঃ) আল্লাহর প্রেরিত একজন রাসূল? তারা এভাবে বলতে চাইছিল, এটা কি তোমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য? কিন্তু দুর্বল মনে করা সেই সাধারণ ঈমানদাররা দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দিল, হ্যাঁ, আমরা তাঁর আনা বার্তায় পূর্ণ বিশ্বাস করি। ]

আয়াত ৭ : ৭৬ - ৭৯

  • যারা অহঙ্কার করেছিল তারা বলল, ‘নিশ্চয় তোমরা যার প্রতি ঈমান এনেছ, আমরা তার প্রতি অস্বীকারকারী’।

[ এ আয়াতে সামূদ জাতির দুই দলের কথোপকথন উল্লেখ করা হয়েছে। একদল সালেহ (আঃ)-এর প্রতি ঈমান এনেছিল, আরেকদল ছিল অবিশ্বাসী। যারা অহংকারী ও নেতৃস্থানীয় ছিল, তারা দুর্বল ও সাধারণ বিশ্বাসীদের উদ্দেশ্যে বলল, “তোমরা কি সত্যিই বিশ্বাস কর যে, সালেহ তার প্রভুর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল?”
ঈমানদাররা উত্তর দিল, “হ্যাঁ, তিনি যে দিকনির্দেশনা নিয়ে এসেছেন, আমরা তাতে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী।” এ উত্তরে বোঝা যায়, তাদের কাছে রাসূলের সত্যতা কোনো বিতর্কের বিষয় ছিল না; বরং একেবারেই সুস্পষ্ট সত্য। মূল প্রশ্ন কেবল এটুকুই—কে বিশ্বাস করবে আর কে করবে না। কিন্তু মুমিনদের এ দৃঢ় জবাব শুনেও অবিশ্বাসীরা অহংকারে অটল থেকে বলল, “তোমরা যে বিষয়ে বিশ্বাস করেছ, আমরা তা মানি না।”]

  • অতঃপর তারা সে উষ্ট্রীকে হত্যা করে এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করে এবং বলে, ‘হে সালিহ! তুমি আমাদেরকে যার ভয় দেখাচ্ছে, তা নিয়ে এস, যদি তুমি রাসূলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাক।
  • অতঃপর তাদেরকে প্রবল ভূমিকম্প আঘাত করল, ফলে তারা নিজেদের ঘরে উপুড় হয়ে পড়ে রইল।

[ আয়াতে সামূদ জাতির কঠোর অবাধ্যতা ও অবিশ্বাসের পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তাদের জন্য একটি মহা নিদর্শনস্বরূপ আশ্চর্য উষ্ট্রী পাঠিয়েছিলেন। এটি ছিল তাদের জন্য সর্বশেষ পরীক্ষা। উষ্ট্রী প্রতিদিন সেই কূপের সব পানি পান করত, যেখান থেকে জনপদের মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীরা পানি পান করত। সালেহ আলাইহিস সালাম এই নিয়ম ঠিক করেছিলেন—একদিন উষ্ট্রী পানি পান করবে, পরের দিন মানুষ ও প্রাণীরা। উষ্ট্রীর এই আচরণ সামূদ জাতির জন্য কিছুটা অসুবিধা সৃষ্টি করেছিল। ফলে তারা উষ্ট্রীর ধ্বংস কামনা করত, তবে আল্লাহর শাস্তির ভয় দেখিয়ে কেউ সরাসরি তা করতে সাহস পেত না।

কিন্তু জাতির এক হতভাগ্য যুবক উষ্ট্রীকে হত্যা করার উদ্যোগ নিল। প্রথমে সে তীর ছুড়ল, পরে তরবারি দ্বারা উষ্ট্রীর পা কেটে দিল। কুরআনে তাকে বলা হয়েছে “إِذِ انْبَعَثَ أَشْقَاهَا” — “তাদের মধ্যে সবচেয়ে হতভাগা ব্যক্তি।” তার এই কাজের কারণে পুরো জাতি ধ্বংসের মুখে পড়ল।

ঘটনার পর সালেহ (আ.) সতর্ক করে বললেন—“এখন থেকে তোমাদের আয়ু মাত্র তিন দিন বাকি।” এরপর নিশ্চিতভাবেই আল্লাহর আযাব নেমে আসবে। কিন্তু তারা অনুতপ্ত হওয়ার বদলে সালেহ (আ.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করল। কয়েকজন রাতের অন্ধকারে তার বাড়ির দিকে এগোলো, কিন্তু আল্লাহ তাদের ধ্বংস করে দিলেন। কুরআনে আল্লাহ বলেনঃ “তারা ষড়যন্ত্র করল, আমিও পরিকল্পনা করলাম, কিন্তু তারা টেরও পেল না।” [সূরা আন-নামল: ৫০]

শেষপর্যন্ত তাদের উপর আঘাত হানল দ্বৈত আযাব—নীচ থেকে ভূমিকম্প আর উপরের দিকে ভয়াবহ চিৎকার। মুহূর্তেই সবাই নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে গেল, তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো। - তাফসীরে জাকারিয়া]

  • এরপর তিনি তাদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! আমি তো আমার প্রতিপালকের বাণী তোমাদের নিকট পৌঁছিয়েছিলাম এবং তোমাদের কল্যাণ কামনা করেছিলাম, কিন্তু তোমরা কল্যাণকামীদেরকে পছন্দ করো না।

[ স্বজাতির উপর আযাব নাযিল হওয়ার পর সালেহ আলাইহিস সালাম ও ঈমানদারগণ সে এলাকা পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান। সালেহ আলাইহিস সালাম প্রস্থানকালে জাতিকে সম্বোধন করে বললেনঃ হে আমার সম্প্রদায়, আমি তোমাদেরকে প্রতিপালকের বাণী পৌছে দিয়েছি এবং তোমাদের কল্যাণ কামনা করেছি, কিন্তু আফসোস, তোমরা কল্যাণকামীদেরকে পছন্দই করো না। - তাফসীরে জাকারিয়া ]


আয়াত ৭ : ৮০ - ৮৪

  • আর আমি লূতকেও পাঠিয়েছিলাম। তিনি তার সম্প্রদায়কে বলেছিলেন, “তোমরা কি এমন খারাপ কাজ করে যাচ্ছ যা তোমাদের আগে সৃষ্টিকুলের কেউ করেনি?
  • তোমরা তো কাম-তৃপ্তির জন্য নারীদের ছেড়ে পুরুষের কাছে যাও, বরং তোমরা সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়।
  • উত্তরে তার সম্প্রদায় শুধু বলল, ‘এদের (লূত্ব এবং তার সঙ্গীদের)কে জনপদ হতে বহিষ্কৃত কর। এরা তো এমন লোক যারা পবিত্র থাকতে চায়।
  • অতঃপর আমরা তাকে ও তার পরিজনদের সবাইকে উদ্ধার করেছিলাম, তার স্ত্রী ছাড়া, সে ছিল ধ্বংসপ্রাপ্তদের অন্তর্ভূত।
  • আর আমরা তাদের উপর ভীষণভাবে বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলাম। কাজেই দেখুন, অপরাধীদের পরিণাম কিরূপ হয়েছিল।

লূত আলাইহিস সালাম ও সাদূম জাতি

লূত আলাইহিস সালাম ছিলেন ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ভ্রাতুষ্পুত্র। উভয়ের মাতৃভূমি ছিল পশ্চিম ইরাকে, প্রসিদ্ধ বাবেল শহরের নিকটে। সেখানে মূর্তিপূজা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল, এমনকি ইবরাহীম আলাইহিস সালামের পরিবারও শুরুতে মূর্তিপূজায় লিপ্ত ছিল। আল্লাহ্ তা'আলা ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে নবী হিসেবে প্রেরণ করেন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তাঁর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করে। ফলে তিনি স্ত্রী সারা ও ভ্রাতুষ্পুত্র লূতকে নিয়ে সিরিয়ার দিকে হিজরত করেন।

পরে আল্লাহ্ তা'আলা লূত আলাইহিস সালামকে নবুওয়াত দান করেন এবং তাঁকে জর্দান নদীর তীরবর্তী সাদূম নগরীর অধিবাসীদের পথপ্রদর্শনের জন্য প্রেরণ করেন। সাদূম এবং এর আশেপাশের শহরগুলো কুরআনে “মু’তাফেকা” নামে উল্লেখিত হয়েছে। এ অঞ্চল ছিল উর্বর, ফলশস্য ও শস্যপূর্ণ। কিন্তু এ জাতির মানুষ এমন এক অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয়েছিল, যা আগে কোনো জাতি করেনি—তারা নারীদের বাদ দিয়ে পুরুষদের সাথে কামবাসনা চরিতার্থ করত। কুরআনে এটিকে সীমালঙ্ঘনকারী অশ্লীলতা হিসেবে নিন্দা করা হয়েছে।

লূত আলাইহিস সালাম বারবার তাদের সতর্ক করলেও তারা তাঁর উপদেশ প্রত্যাখ্যান করে বিদ্রূপ করতে থাকে। অবশেষে আল্লাহ্ তা'আলা তাদের উপর মহা আযাব প্রেরণ করেন। শুধু লূত আলাইহিস সালাম ও তাঁর কয়েকজন মুসলিম অনুসারী বেঁচে যান। তবে তাঁর স্ত্রী ধ্বংস হয়, কারণ তিনি অবিশ্বাসীদের সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলেন।

সাদূমের আযাব ছিল ভয়াবহ। উপর থেকে স্তরে স্তরে প্রস্তর বর্ষণ হয় এবং নীচ থেকে ভূখণ্ড উল্টে দেয়া হয়। ফলে গোটা জনপদ মুহূর্তেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

আজও সেই স্থান বিদ্যমান—জর্দান নদীর দক্ষিণাংশে অবস্থিত মৃত সাগর (Dead Sea), যা পৃথিবীর সবচেয়ে নীচু ভূ-অঞ্চল। এখানে পানিতে কোনো মাছ বা প্রাণী বাঁচতে পারে না। এ নিদর্শন আজও মানুষের সামনে প্রমাণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, যেন সবাই শিক্ষা নেয় যে, অশ্লীলতা ও আল্লাহর বিধান অমান্যই ধ্বংসের আসল কারণ।


আয়াত ৭ : ৮৫ - ৯৩

  • আর মাদয়ানবাসীদের নিকট তাদের ভাই শু’আইবকে পাঠিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্‌র ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই; তোমাদের রবের কাছ থেকে তোমাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ এসেছে। কাজেই তোমরা মাপ ও ওজন ঠিকভাবে দেবে, লোকদেরকে তাদের প্রাপ্য বস্তু কম দেবে না এবং দুনিয়ার শান্তি স্থাপনের পর বিপর্যয় ঘটাবে না । এটি তোমাদের জন্যই উত্তম, যদি তোমরা ঈমানদার হও।
  • আর তোমরা এই উদ্দেশ্যে পথে পথে বসে থেকো না যে, তোমরা বিশ্বাসীগণকে ভীতি প্রদর্শন করবে, আল্লাহর পথে তাদেরকে বাধা দেবে এবং ওতে বক্রতা (দোষ-ত্রুটি) অনুসন্ধান করবে। স্মরণ কর, তোমরা যখন সংখ্যায় কম ছিলে, আল্লাহ তখন তোমাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছেন। আর বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কিরূপ ছিল, তা লক্ষ্য কর।
  • আমি যা নিয়ে প্রেরিত হয়েছি তাতে যদি তোমাদের কোন দল ঈমান আনে এবং কোন দল ঈমান না আনে, তবে ধৈর্য ধর, যতক্ষন না আল্লাহ আমাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেন, আর তিনিই শ্ৰেষ্ঠ ফয়সালাকারী।
  • তার সম্প্রদায়ের অহংকারী নেতার বলল, হে শু'আইব! আমরা অবশ্যই তোমাকে ও তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে আমাদের জনপদ থেকে বের করে দেব অথবা তোমাদেরকে আমাদের ধর্মাদর্শে ফিরে আসতে হবে। তিনি বললেন, যদিও আমরা সেটাকে ঘৃণা করি তবুও?
  • তোমাদের ধর্মাদর্শ থেকে আল্লাহ আমাদেরকে উদ্ধার করার পর যদি আমরা তাতে ফিরে যাই তবে তো আমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপ করব। আর আমাদের রব আল্লাহ ইচ্ছে না করলে তাতে ফিরে যাওয়া আমাদের জন্য সমীচীন নয়। সবকিছুই আমাদের রবের জ্ঞানের সীমায় রয়েছে, আমরা আল্লাহ্‌র উপরই নির্ভর করি। হে আমাদের রব! আমাদের ও আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ন্যায্যভাবে ফয়সালা করে দিন এবং আপনিই শ্রেষ্ঠ ফয়সালাকারী।
  • আর তার সম্প্রদায়ের নেতাদের মধ্যে যারা কুফরী করেছিল তারা বলল, তোমরা যদি শু'আইবকে অনুসরণ কর, তবে নিশ্চয় তোমরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
  • অতঃপর তারা ভূমিকম্প দ্বারা আক্রান্ত হল, ফলে তারা নিজ গৃহে উপুড় অবস্থায় ধ্বংস হয়ে গেল।
  • মনে হল শুআইবকে যারা মিথ্যাজ্ঞান করেছিল, তারা যেন কখনো সেখানে বসবাসই করেনি। শুআইবকে যারা মিথ্যা ভেবেছিল, তারাই ছিল ক্ষতিগ্রস্ত।
  • অতঃপর তিনি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং বললেন , হে আমার সম্প্রদায়! আমার প্রতিপালকের সমাচার তো আমি তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি এবং তোমাদেরকে উপদেশ দিয়েছি। সুতরাং আমি এক অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য কি করে আক্ষেপ করি ?

মাদয়ান জাতি ও শূয়াইব আলাইহিস সালামের প্রেক্ষাপট

‘মাদয়ান’ ছিল ইবরাহীম (আঃ)-এর পুত্র বা পৌত্রের নাম। পরবর্তীতে তাঁর বংশধরদের থেকেই একটি গোত্র গড়ে ওঠে, যাদের নাম হয় মাদয়ান। তারা যে গ্রামে বসবাস করত, সেই গ্রামটিও একই নামে পরিচিত হয়। অর্থাৎ, মাদয়ান শব্দটি গোত্র ও জনপদ—উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।

বর্তমান সময়ে মাদয়ানের নাম ‘আল বিদা’। এটি সৌদি আরবের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে, মিশরের সীমান্ত সংলগ্ন একটি প্রসিদ্ধ জনপদ। ঐ এলাকায় এখনো শু‘আইব (আঃ)-এর জাতির ধ্বংসাবশেষ ও নিদর্শনসমূহ বিদ্যমান, যা স্থানীয়ভাবে মাগায়ের শু‘আইব নামে পরিচিত। (তথ্যসূত্র: ড. শাওকী আবু খালীল, আতলাসুল কুরআন, পৃ. ৭২)

শূয়াইব আলাইহিস সালাম ছিলেন ‘মাদয়ান’ জাতির প্রতি আল্লাহর প্রেরিত নবী। তিনি পূর্ববর্তী নবীদের মতই এক আল্লাহর ইবাদত ও ন্যায়পরায়ণ জীবনধারার দাওয়াত প্রচার করতেন। তার লক্ষ্য ছিল জনগণকে সত্যের পথে ফিরিয়ে আনা, সমাজে ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠা করা এবং ব্যবসায়িক প্রতারণা ও সামাজিক অবিচার বন্ধ করা।

‘মাদয়ান’ জাতি ছিল অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী । তবে তারা দারিদ্র্য বা দৈনন্দিন জীবনের অভাবের কারণে নয়, বরং অহংকার ও অসৎ প্রবৃত্তির কারণে অবাধ্য হয়ে উঠেছিল। তাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল:

  • ব্যবসায়িক প্রতারণা, ওজন ও মাপ কমানো।
  • মানুষকে ফাঁকি দেওয়া, নিজস্ব স্বার্থে অন্যদের ক্ষতি করা।
  • আল্লাহর বিধান অমান্য করা ও সামাজিক অবিচারে লিপ্ত থাকা।
  • ভূমি ও পরিবেশের অযথা বিনাশ ঘটানো।

আল্লাহ্‌ শূয়াইব (আঃ)-কে নবী হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন এই জাতিকে হেদায়াত প্রদানের জন্য। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রজ্ঞাবান, বাকপটু ও আল্লাহভীরু একজন নবী। কুরআনে তাকে “খাতীবুল-আম্বিয়া” (নবীদের বক্তা) বলা হয়, কারণ তিনি কোমল ও স্পষ্ট ভাষায় তার সম্প্রদায়কে উপদেশ দিতেন।

তিনি তাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদাত এবং সৎ জীবনাচরণের প্রতি আহ্বান জানাতেন। বিশেষভাবে তিনি সতর্ক করেছিলেন—তারা যখন বাণিজ্যে অন্যায় ও প্রতারণা করবে, ও মানুষদের মাপ ও ওজন কমাবে, তখন তারা আল্লাহর শাস্তির যোগ্য হবে।

কুরআনে তাদের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করা হয়েছে: তারা বলেছিল— “হে শু‘আইব! তোমার নামাজই কি তোমাকে এ নির্দেশ দেয় যে আমরা আমাদের পিতৃপুরুষেরা যাদের উপাসনা করত তাদেরকে ত্যাগ করব, অথবা আমাদের সম্পদ নিয়ে আমরা যা চাই তা করতে পারব না? নিশ্চয়ই তুমি তো অত্যন্ত সহনশীল ও সৎ-চালিত! - সূরা হূদ (১১:৮৭) ?” অধিকাংশ মাদয়ানবাসী তার দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল। তারা উপহাস করল, হুমকি দিল এবং বলল যে, শূ‘আইব ও তার অনুসারীদের শহর থেকে বের করে দেওয়া হবে।

ফলে আল্লাহ তা’আলা তাদের উপর আযাব নাযিল করেছিলেন। তারা অবাধ্যতায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে আল্লাহ তাদের উপর ভয়াবহ আযাব প্রেরণ করেন। বিভিন্ন আয়াতে তাদের আযাবকে ভিন্ন ভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে:

  • ভূমিকম্প (رجفة): তারা ঘরে হাঁটু গেড়ে লুটিয়ে পড়ে গেল। (আ‘রাফ ৭:৯১)
  • বিকট চিৎকার (صيحة): প্রবল শব্দে তাদের প্রাণ নিঃশেষ হয়ে গেল। (হূদ ১১:৯৪)
  • ছায়ার আযাব (ظلة): প্রচণ্ড গরমের পর সবাই মেঘের নিচে আশ্রয় নিল, তারপর আগুন ও ভূমিকম্পে ধ্বংস হলো। (শু‘আরা ২৬:১৮৯)

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন: প্রথমে তাদের উপর ভীষণ গরম চাপানো হয়, যাতে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তারা বনাঞ্চলে ছুটে গিয়ে মেঘের ছায়ার নিচে ভিড় করল। তখন মেঘ আগুনে রূপ নিল, নিচ থেকে ভূমিকম্প শুরু হলো এবং সবাই ধ্বংস হয়ে গেল।

যারা ঈমানদার ও শূয়াইব আলাইহিস সালামের অনুসারী ছিলেন, তারা আযাব থেকে বেঁচে রক্ষা পেয়েছিলেন।


আয়াত ৭ : ৯৪ - ৯৬

  • আর আমরা কোন জনপদে নবী পাঠালেই সেখানকার অধিবাসীদেরকে অর্থ-সংকট ও দুঃখ-কষ্ট দ্বারা আক্রান্ত করি, যাতে তারা কাকুতি-মিনতি করে।
  • তারপর আমরা অকল্যাণকে কল্যাণে পরিবর্তিত করি। অবশেষে তারা প্রাচুর্যের অধিকারী হয় এবং বলে, আমাদের পূর্বপুরুষরাও তো দুঃখ-সুখ ভোগ করেছে। অতঃপর হঠাৎ আমরা তাদেরকে পাকড়াও করি, এমনভাবে যে, তারা উপলব্ধিও করতে পারে না।

[ আল্লাহ তাআলার নিয়ম হলো—যখন তিনি কোনো সম্প্রদায়ের কাছে নবী পাঠান, তখন প্রথমে তাদেরকে নানা কষ্ট ও বিপদে ফেলেন। কখনো দুর্ভিক্ষ, কখনো রোগ-বালাই, কখনো দারিদ্র্য—যাতে তারা অহংকার ছেড়ে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে এবং নবীর কথা মানে।

কিন্তু যদি তারা এই কষ্ট থেকে শিক্ষা না নেয়, তবে আল্লাহ তাদেরকে উল্টোভাবে পরীক্ষা করেন—তাদের জীবনকে সহজ করে দেন, সম্পদ ও সুখ-শান্তি বাড়িয়ে দেন। উদ্দেশ্য ছিল, তারা যেন কৃতজ্ঞ হয়ে আল্লাহর ইবাদত করে।

কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা করল না। তারা ভাবল—এ তো স্বাভাবিক ব্যাপার। আমাদের পূর্বপুরুষেরাও কখনো কষ্টে, কখনো সুখে ছিল। এর মধ্যে আল্লাহর কোনো শিক্ষা নেই।

এভাবে তারা যখন উদাসীন হলো, তখন হঠাৎ করে আল্লাহর শাস্তি তাদের উপর নেমে এলো। তারা কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।

এখানে শিক্ষা হলো—কষ্ট ও সুখ দুটোই আল্লাহর পরীক্ষা। কষ্টে ধৈর্য ধরতে হবে, আর সুখে কৃতজ্ঞ হতে হবে। নইলে শেষ পরিণতি খুব ভয়াবহ হতে পারে। ]

  • আর যদি সে সব জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত তবে অবশ্যই আমরা তাদের জন্য আসমান ও যমীনের বরকতসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম , কিন্তু তারা মিথ্যারোপ করেছিল; কাজেই আমরা তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদেরকে পাকড়াও করলাম।

আয়াত ৭ : ৯৭ - ১০২

  • তবে কি জনপদের অধিবাসীরা ভয় রাখে না যে, আমার শাস্তি তাদের উপর আসবে রাত্রিকালে, যখন তারা থাকবে ঘুমে মগ্ন ?

[ এই আয়াতে আল্লাহ সতর্ক করেছেন যে কোনো নগরবাসীই নিরাপদ নয়, যদি তারা অবিশ্বাসী বা অপরাধী হয়। তাদের ওপর আযাব এমন সময়ও নেমে আসতে পারে যখন তারা ঘুমাচ্ছে, অর্থাৎ তারা কোনোভাবেই প্রস্তুত বা রক্ষা পাবে না। ]

  • নাকি জনপদের অধিবাসীরা নিরাপদ হয়ে গেছে যে, আমাদের শাস্তি তাদের উপর আসবে দিনের বেলা, যখন তারা খেলাধুলায় মেতে থাকবে?

[ এই আয়াতটি মানুষের জন্য একটি গুরুতর সতর্কবার্তা। এটি বলছে, কোনো শহরের বাসিন্দারা নিশ্চিন্ত হতে পারে না যে, তারা আরাম-আয়েশা বা বিনোদনে মগ্ন থাকাকালীন আল্লাহর শাস্তি তাদেরকে স্পর্শ করবে না। যারা অবাধ্যতা ও অন্যায়ে লিপ্ত থাকে, তাদের ওপর আল্লাহ হঠাৎ এবং অপ্রত্যাশিতভাবে শাস্তি নাজিল করতে পারেন। তাই মানুষকে সবসময় সচেতন থাকা, সৎ পথে চলা এবং অন্যায় থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। ]

  • তারা কি আল্লাহর পরিকল্পনার ভয় রাখে না? বস্তুতঃ ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় ব্যতীত কেউই আল্লাহর চক্রান্ত হতে নিরাপদ বোধ করে না।

[ এই আয়াতটি আমাদের সতর্ক করে যে, কেউই আল্লাহর পরিকল্পনা বা শাস্তি থেকে নিরাপদ নয়। যারা পাপাচার করে, অন্যায় চালায় এবং আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে, তারা ভাবতে পারে যে তাদের অপরাধ কোনোভাবে আল্লাহর নজর এড়াতে পারবে। কিন্তু আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং তার পরিকল্পনা নিখুঁত। যারা অহংকার ও অবাধ্যতায় মগ্ন থাকে, তাদের অবশেষে ক্ষতি ও ধ্বংসের সম্মুখীন হতে হয়। ]

  • কোন দেশের অধিবাসীর ধ্বংসের পর যারা ওর উত্তরাধিকারী হয়েছে, তাদের নিকট এটা কি প্রতীয়মান হয়নি যে, আমি ইচ্ছা করলে তাদের পাপের দরুন তাদেরকে শাস্তি দিতে পারি এবং তাদের হৃদয় মোহর করে দিতে পারি; ফলে তারা শুনবে না

[ এই আয়াত আমাদের বোঝায় যে, পাপের ফলে শুধু শাস্তিই আসে না; বরং মানুষের অন্তরেও তালা লাগিয়ে দেয়া হয়। তখন বড় বড় বিপদ বা আযাবও তাদেরকে সতর্ক বা সচেতন করতে পারে না। যেমন পূর্বের পাপী জাতিকে আল্লাহ তাদের পাপের কারণে ধ্বংস করেছেন, তেমনি তিনি চাইলে বর্তমানে যারা অবাধ্য থাকে তাদেরকেও ধ্বংস করতে পারতেন। এটি একটি শিক্ষণীয় বিষয় যে, পাপের অভ্যাস যখন অব্যাহত থাকে, তখন মানুষের অন্তর সত্য উপলব্ধি করতে অক্ষম হয়ে যায়। এ অবস্থায় ভীতি প্রদর্শন বা উপদেশও কার্যকর হয় না।]

  • আর আমরা তাদের অধিকাংশকে প্রতিশ্রুতি পালনকারী পাইনি; বরং আমরা তাদের অধিকাংশকেই ফাসিক (আল্লাহর অবাধ্য) অবস্থায় পেয়েছি ।

[ আল্লাহ এখানে অতীতের ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদগুলোর ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। তাদের কাছে নবী-রাসূলরা স্পষ্ট প্রমাণ ও নিদর্শন নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু তারা বিশ্বাস করেনি। কারণ, তারা আগে থেকেই অবিশ্বাসে অটল ছিল। তাই সত্যের প্রমাণ দেখিয়েও তারা ঈমান গ্রহণ করেনি। আল্লাহ জানিয়ে দেন—যারা অহংকার ও অবিশ্বাসে অটল থাকে, তাদের অন্তরে তিনি সীলমোহর বসিয়ে দেন। ফলে তাদের হৃদয় আর সত্যকে গ্রহণ করতে পারে না, আর তারা অবশেষে ধ্বংসের পথে চলে যায়। ]

  • এসব জনপদের কিছু বিবরণ আমরা আপনার কাছে বর্ণনা করছি, তাদের কাছে তাদের রাসূলগুণ তো স্পষ্ট প্রমাণসহ এসেছিলেন; কিন্তু যা তারা পূর্বে মিথ্যা মনে করেছিল, তাতে তারা আর বিশ্বাস করবার ছিল না। এভাবে আল্লাহ অবিশ্বাসীদের হৃদয়ে সীল মেরে দেন।

আয়াত ৭ : ১০৩ - ১০২

  • তারপর আমরা তাদের পরে মূসাকে আমাদের নিদর্শনসহ ফিরআউন ও তার পরিষদবর্গের কাছে প্রেরণ করেছি; কিন্তু তারা তা অস্বীকার করল। সুতরাং এই বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কি হয়েছিল তা লক্ষ্য করুন।

  • আর মূসা বললেন, হে ফিরআউন, নিশ্চয় আমি সৃষ্টিকুলের রবের কাছ থেকে প্রেরিত।

  • এটা স্থির নিশ্চিত যে, আমি আল্লাহ সম্বন্ধে সত্য ছাড়া বলব না। তোমাদের রবের কাছ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে আমি তোমাদের কাছে এসেছি, কাজেই বনী ইসরাঈলকে তুমি আমার সাথে পাঠিয়ে দাও।

  • ফিরআউন বলল, যদি তুমি কোন নিদর্শন এনে থাক, তবে তুমি সত্যবাদী হলে তা পেশ কর।

  • অতঃপর মূসা তার হাতের লাঠি নিক্ষেপ করলেন এবং সাথে সাথেই তা এক অজগর সাপে পরিণত হল।

  • এবং তিনি তার হাত বের করলেন আর সাথে সাথেই তা দর্শকদের কাছে শুভ্র উজ্জ্বল দেখাতে লাগল।

  • ফিরআউন সম্প্রদায়ের নেতারা বলল, এ তো একজন সুদক্ষ জাদুকর ,

  • এ তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বের করে দিতে চায়, এখন তোমরা কি পরামর্শ দাও?

  • তারা বললঃ তাকে এবং তার ভাইকে (হারুন) কিছু দিনের জন্য অবকাশ দিন, আর শহরে শহরে সংগ্রাহক পাঠিয়ে দিন,

  • যেন তারা আপনার নিকট প্রতিটি সুদক্ষ যাদুকর উপস্থিত করে।

  • যাদুকরেরা ফিরাউনের নিকট এসে বলল, আমরা যদি বিজয়ী হই, তাহলে আমাদের জন্য পুরস্কার থাকবে তো?

  • সে বলল, হ্যাঁ! এবং তোমরা অবশ্যই আমার সান্নিধ্যপ্রাপ্তদেরও অন্তর্ভুক্ত হবে।

  • অতঃপর যাদুকরেরা বললঃ হে মূসা! তুমি কি তোমার লাঠি নিক্ষেপ করবে, নাকি আমরাই (প্রথমে) নিক্ষেপ করব?

  • তিনি বললেন, ‘তোমরাই নিক্ষেপ কর। অতঃপর যখন তারা নিক্ষেপ করল তখন তারা লোকদের চোখে ধাঁধাঁর সৃষ্টি করল এবং তাদেরকে ভীত ও আতংকিত করল, তারা এক বড় রকমের যাদু দেখাল।

  • আর আমরা মূসার কাছে ওহী পাঠালাম যে, আপনি আপনার লাঠি নিক্ষেপ করুন। সাথে সাথে সেটা তারা যে অলীক বস্তু বানিয়েছিল তা গিলে ফেলতে লাগল;

[ ফেরআউনের যাদুকররা যখন দড়ি ও লাঠি ফেলে যাদু প্রদর্শন করল, তখন সেগুলো মানুষের চোখে সাপের মতো নড়াচড়া করতে লাগল। এতে উপস্থিত লোকেরা বিভ্রান্ত হলো। তখন আল্লাহ মূসা (আঃ)-কে নির্দেশ দিলেন তাঁর লাঠি ফেলে দিতে। মূসা (আঃ)-এর লাঠি আল্লাহর ক্ষমতায় প্রকৃত সাপ হয়ে যাদুকরদের সব মিথ্যা প্রদর্শনীকে গিলে ফেলল। ]

  • ফলে সত্য প্রতিষ্ঠিত হল এবং তারা যা করছিল তা বাতিল হয়ে গেল।

  • তারা ( ফির‘আউন ও তার দলবলের লোকেরা ) সেখানে পরাজিত হল আর লাঞ্ছিত অবস্থায় ফিরে গেল।

  • আর যাদুকররা সাজদায় লুটিয়ে পড়ল।

  • তারা বলল, আমরা বিশ্বজগতের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনলাম।

  • যিনি মূসা ও হারূনেরও প্রতিপালক।

  • ফির‘আউন বললঃ আমি অনুমতি দেয়ার আগেই তোমরা তার উপর ঈমান আনলে ? নিশ্চয় এটি একটি চক্রান্ত; যা তোমরা এ নগরে চালিয়েছ, যাতে নগরবাসীদেরকে সেখান হতে বহিষ্কার করতে পার। অতএব শীঘ্রই তোমরা এর পরিণাম জানতে পারবে।

  • অবশ্যই অবশ্যই আমি তোমাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে টুকরো করে ফেলব; তারপর অবশ্যই তোমাদের সবাইকে শূলে চড়াব।

  • তারা বলল, ‘আমরা অবশ্যই আমাদের প্রতিপালকের নিকট ফিরে যাব।

[ এই কথা বলেছিলেন সেই যাদুকররা, যারা ফেরআউনের সামনে মূসা (আঃ)-এর অলৌকিক মুজিযা দেখে ঈমান এনেছিলেন। ফেরআউন তাদের কঠিন শাস্তির হুমকি দিয়েছিল—হাত-পা কেটে ফেলা এবং ক্রুশবিদ্ধ করার। কিন্তু তারা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিল: “আমরা তো যাই হোক একদিন আমাদের প্রতিপালকের কাছেই ফিরে যাব।” অর্থাৎ, মৃত্যু আমাদের জন্য ভয়ের কিছু নয়। ফেরআউনের শাস্তি সাময়িক, কিন্তু আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়াই চিরসত্য। এই বাক্যে তাদের ঈমানের দৃঢ়তা, ধৈর্য ও আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ পেয়েছে। ]

  • আর তুমি তো আমাদেরকে শাস্তি দিচ্ছ শুধু এ জন্যে যে, আমরা আমাদের রবের নিদর্শনে ঈমান এনেছি যখন তা আমাদের কাছে এসেছে। হে আমাদের রব! আমাদেরকে পরিপূর্ণ ধৈর্য দান করুন এবং মুসলিমরূপে আমাদেরকে মৃত্যু দিন।

  • আর ফিরআউন সম্প্রদায়ের নেতারা বলল, আপনি কি মূসা ও তার সম্প্রদায়কে যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে এবং আপনাকে ও আপনার উপাস্যদেরকে বর্জন করতে দেবেন? সে বলল, শীঘ্রই আমরা তাদের পুত্রদেরকে হত্যা করব এবং তাদের নারীদেরকে জীবিত রাখব। আর নিশ্চয়ই আমরা তাদের উপর শক্তিধর।

  • মূসা তার সম্প্রদায়কে বললেন, আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও এবং ধৈর্য ধর; নিশ্চয় যমীন আল্লাহরই। তিনি তাঁর দাসদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তার উত্তরাধিকারী করেন এবং সাবধানীদের জন্যই তো শুভ পরিণাম!

[ যখন বনি ইসরাইল ফেরআউনের অবিচার ও যুলুমে ভীত ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, তখন মূসা (আঃ) তাদের সাহস জুগিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন—আল্লাহর উপর ভরসা করো, তাঁর সাহায্য চাইো এবং ধৈর্য ধরে থাকো। পৃথিবীর মালিকানা কারো হাতে নেই, সবকিছু আল্লাহর। তিনি যাকে চান শক্তি ও শাসন দেন, আর যাকে চান তা কেড়ে নেন। শেষ পর্যন্ত সফলতা ও কল্যাণ লাভ করবে শুধু আল্লাহভীরু ও সৎকর্মশীল মানুষরা। ]

  • তারা বলল, আপনি আমাদের কাছে আসার আগেও আমরা নির্যাতিত হয়েছি এবং আপনি আসার পরও। তিনি বললেন, শীঘ্রই তোমাদের রব তোমাদের শক্রকে ধ্বংস করবেন এবং তিনি তোমাদেরকে যমীনে স্থলাভিষিক্ত করবেন, তারপর তোমরা কি কর তা তিনি লক্ষ্য করবেন।

[ বনি ইসরাইল মূসা (আঃ)-এর কাছে দুঃখ প্রকাশ করল যে, তারা সবসময়ই ফেরআউনের যুলুমের শিকার—মূসা আসার আগে যেমন ছিল, আসার পরও তেমনি চলছে। তখন মূসা (আঃ) তাদের ধৈর্য ধরতে বলেন এবং আশার আলো দেখান। তিনি বুঝিয়ে দেন—আল্লাহ অচিরেই ফেরআউন ও তার বাহিনীকে ধ্বংস করবেন এবং বনি ইসরাইলকে ভূমির উত্তরাধিকারী করবেন। তবে এর সাথে তিনি সতর্কও করলেন যে, ক্ষমতা পেলে তোমরা কেমন আচরণ করবে, তা আল্লাহ অবশ্যই দেখবেন। ]

  • আর অবশ্যই আমরা ফিরআউনের অনুসারীদেরকে দুর্ভিক্ষ ও ফল ফসলের ক্ষতির দ্বারা আক্রান্ত করেছি, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।

  • অতঃপর যখন তাদের কাছে কোন কল্যাণ আসত, তারা বলত, ‘এতো আমাদের প্রাপ্য।’ আর যখন কোন অকল্যাণ হত, তখন তা মূসা ও তার সঙ্গীদেরকে অশুভ কারণরূপে মনে করত। প্রকৃতপক্ষে তাদের অকল্যাণ আল্লাহরই নিয়ন্ত্রণাধীন, কিন্তু তাদের অধিকাংশ সে সম্পর্কে কোন জ্ঞান রাখেনা।

  • আর তারা বলত, আমাদেরকে যাদু করার জন্য তুমি যে কোন নিদর্শন আমাদের নিকট উপস্থিত কর না কেন, আমরা তোমাতে বিশ্বাস করব না।

  • অতঃপর আমরা তাদেরকে প্লাবন, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ ও রক্ত দ্বারা ক্লিষ্ট করি; এগুলি ছিল স্পষ্ট নিদর্শন। কিন্তু তারা দাম্ভিকই রয়ে গেল, আর তারা ছিল এক অপরাধী সম্প্রদায়।

[ ফিরআউনের জাদুকরদের সঙ্গে সংঘর্ষের পরও মূসা আলাইহিস সালাম দীর্ঘ সময় মিসরে অবস্থান করে জনগণকে আল্লাহর বাণী শুনিয়েছেন এবং সত্যপথের দিকে আহবান জানিয়েছেন। আল্লাহ তাকে নয়টি নিদর্শন প্রদান করেছিলেন, যাতে ফিরআউনের সম্প্রদায়কে সতর্ক করে সত্যপথে ফিরিয়ে আনা যায়।

প্রথম দুটি নিদর্শন হলো—লাঠি সাপে পরিণত হওয়া এবং হাতের শুভ্রতা, যা ফিরআউনের দরবারে প্রদর্শিত হয় এবং জাদুকরদের বিরুদ্ধে মূসা আলাইহিস সালামের জয় নিশ্চিত করে। পরবর্তী নিদর্শনটি ছিল দুর্ভিক্ষ, যা তাদের ক্ষেত-ফসল ও বাগানের উৎপাদন কমিয়ে দেয়। ফলে তারা দারিদ্র্য ও অসহায়তার মধ্যে পড়ে এবং মূসা আলাইহিস সালামের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে দোআ করে মুক্তি প্রার্থনা করে। কিন্তু দুর্ভিক্ষ চলে যাওয়ার পর তারা আবার নিজেদের অহংকার ও হঠকারিতায় ফিরে যায়, বলত—“দূর্ভিক্ষ আমাদের নিজের কর্মকাণ্ডের কারণে নয়, এটি মূসা আলাইহিস সালামের সঙ্গীদের কারণে ঘটেছিল।”

এরপর আল্লাহ ছয়টি অন্যান্য নিদর্শন প্রেরণ করেন—তুফান, পঙ্গপাল, ঘুন-পোকা, ব্যাঙ এবং রক্ত। এই পাঁচ প্রকারের আযাব তাদের উপর নাযিল হয়। এসব আযাবের পরে তারা মূসা আলাইহিস সালামের কাছে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, এ আযাব থেকে মুক্তি পেলে তারা ঈমান আনবে। মূসা আলাইহিস সালামের দোআর ফলে তারা মুক্তি পায়।

কিন্তু যেসব জাতির উপর আল্লাহর আযাব চাপা পড়ে, তাদের বুদ্ধি ও চেতনা কার্যকর হয় না। তাই আযাব থেকে মুক্তি পাওয়ার পরও তারা আবার নিজেদের হঠকারিতা ও অবিশ্বাসে ফিরে যায় এবং ঈমান আনতে অস্বীকার করে।]

  • আর যখন তাদের উপর আযাব পতিত হল তখন তারা বলল, ‘হে মূসা আমাদের জন্য তুমি তোমার রবের কাছে দুআ কর তিনি যে ওয়াদা তোমার সাথে করেছেন সে অনুযায়ী। যদি তুমি আমাদের উপর থেকে আযাব সরিয়ে দাও তাহলে অবশ্যই আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনব এবং অবশ্যই তোমার সাথে বনী ইসরাঈলকেও যেতে দেব।

  • কিন্তু আমরা যখনই তাদের উপর থেকে শাস্তি দূর করে দিতাম এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য যা তাদের জন্য নির্ধারিত ছিল, তারা তখনই তাদের অঙ্গীকার ভংগ করত।

  • কাজেই আমরা তাদের থেকে প্রতিশোধ নিয়েছি এবং তাদেরকে অতল সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছি। কারণ তারা আমাদের নিদর্শনকে অস্বীকার করত এবং এ সম্বন্ধে তারা ছিল গাফেল।

  • এবং যে সম্প্রদায়কে দুর্বল গণ্য করা হত, তাদেরকে আমি আমার কল্যাণপ্রাপ্ত রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের উত্তরাধিকারী করলাম এবং বনী ইসরাঈল সম্বন্ধে আপনার রবের শুভ বাণী সত্যে পরিণত হল, যেহেতু তারা ধৈর্য ধরেছিল, আর ফিরআউন ও তার সম্প্রদায়ের শিল্প এবং যেসব প্রাসাদ তারা নির্মাণ করেছিল তা ধ্বংস করেছি।

  • আর আমরা বনী ইসরাঈলকে সাগর পার করিয়ে দেই; তারপর তারা মূর্তিপূজায় রত এক জাতির কাছে উপস্থিত হয়। তারা বলল, হে মূসা! তাদের মা’বুদদের ন্যায় আমাদের জন্যও একজন মা’বুদ স্থির করে দাও । তিনি বললেন, তোমরা তো এক মূর্খ জাতি।

[ এই আয়াতটি বনী ইস্রাঈলের বড় ভুল ও অসচেতনতার উদাহরণ। আল্লাহ তাদেরকে ফিরআউনের অত্যাচার থেকে রক্ষা করলেন, সৈন্য-সামন্তসহ তাকে সমুদ্রপারে ডুবিয়ে দিলেন, এবং অলৌকিকভাবে তাদের সমুদ্র পার করালেন। তারপরও তারা মুক্তির পর তৎক্ষণাৎ ভুল পথে ফিরে গেল এবং নিজেরা পাথরের গাভীর আকারের মূর্তির খোঁজ শুরু করল। ]

  • এসব লোক যাতে লিপ্ত রয়েছে, তা তো ধ্বংস করা হবে এবং তারা যা করছে, তাও অমূলক।

  • তিনি আরো বললেন, আল্লাহ ছাড়া তোমাদের জন্য আমি কি অন্য ইলাহ খোঁজ করব অথচ তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টিকুলের উপর শ্ৰেষ্ঠত্ব দিয়েছেন?

  • verse 141